ইউক্রেনের সবচেয়ে বিখ্যাত ও চৌকস পাইলটদের একজন এবং আরো দু’জন বৈমানিক মধ্য আকাশে এক সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর পশ্চিমা গণমাধ্যমে অসংখ্য সাক্ষাতকার দিয়ে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠা পাইলট আন্দ্রি পিলশচিকভের মৃত্যুকে ইউক্রেনের জন্য বিরাট ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
আন্দ্রি পিলশচিকভ ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম দিকেই লড়াইয়ে অংশ নিয়ে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেছিলেন।
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এসব বৈমানিকের মৃত্যুকে ‘দুঃখজনক ও অপূরণীয়’ ক্ষতি হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং পিলশচিকভকে ‘ব্যাপক জ্ঞান ও মেধাসম্পন্ন’ পাইলট হিসেবে বর্ণনা করেছে।
ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চলে মধ্য আকাশে দুটি এল-৩৯ প্রশিক্ষণ বিমানের মধ্যে সংঘর্ষ হলে তারা নিহত হন।
কর্তৃপক্ষ এখন বিমানগুলোর যাত্রা শুরুর আগে যথাযথ প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল কি-না সেটি তদন্ত করে দেখছে। ইউক্রেনের যে অঞ্চলে দুর্ঘটনাটি হয়েছে সেটি রাজধানী কিয়েভের পশ্চিমে এবং যুদ্ধাঞ্চল থেকে শত শত মাইল দূরে।
নিশ্চিত করলেন জেলেনস্কি
প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তার নিয়মিত ভিডিও ভাষণে পাইলটদের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে বলেছেন, ইউক্রেনের আকাশ মুক্ত রাখতে যারা লড়াই করেছে দেশ কখনোই তাদের ভুলবে না।
পিলশচিকভ , যিনি ‘জুস’ প্রতীকী নামে পরিচিত ছিলেন।
গত শরতে রাশিয়া ইউক্রেনে শত শত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছিল। বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন যে- মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানের পাইলট হিসেবে এসব মারণাস্ত্র রুখে দেয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার সময় তিনি কতটা চাপ বোধ করেছিলেন।
ক্রুজ মিসাইল রুখে দেয়ার মাধ্যমে আপনার কাজ হলো শহর ও মানুষের জীবন রক্ষা করা। আপনি যদি সেটি করতে না পারেন তাহলে কেউ মারা যাবে। মিনিটের মধ্যেই কেউ মারা পড়বে এবং আপনি সেটা ঠেকাতে পারছেন না, বলছিলেন তিনি।
তিনি তার সারাজীবনের স্বপ্ন ইউক্রেনের বিমান বাহিনীতে যোগ দেয়ার বিষয়েও কথা বলেছিলেন।
তার একজন বন্ধু মেলানিয়া পডোলিয়াক সামাজিক মাধ্যমে বিমান বাহিনীর ব্যাজসহ ছবি দিয়ে মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছিলেন।
এই বিমান সংঘর্ষ ও মৃত্যুর খবরটি ইউক্রেনের জন্য একটি বড় আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ দেশটি প্রতিরোধ যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য তার সহযোগীদের কাছ থেকে ৬১টি এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বিষয়েও ভূমিকা ছিল
বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগন নিশ্চিত করেছে সেপ্টেম্বরে টেক্সাসে ইউক্রেনের পাইলটদের এসব বিমান চালনার প্রশিক্ষণ শুরু হবে।
এছাড়া অন্য পশ্চিমা কয়েকটি দেশও একই ধরনের প্রশিক্ষণ শুরু করছে চলতি মাসের শেষ থেকেই।
আগামী পাঁচ মাস এ ধরণের প্রশিক্ষণগুলো চলতে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যদিও চলতি বছরের শুরুতে এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান দেয়ার বিষয়ে আমেরিকার সিদ্ধান্ত বছরের শুরুতে পাল্টে গিয়েছিল। কারণ তখন আমেরিকা ও তার সহযোগী ন্যাটো আশঙ্কা করছিল যে- এটি পারমাণবিক শক্তিধর রাশিয়ার সাথে উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ওদিকে ইউক্রেন বিমান বাহিনীর মুখপাত্র পিলশচিকভের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে।
‘এক বছর আগে আন্দ্রি আমেরিকার কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাত করেন। ক্যালিফোর্নিয়ার পাইলটদের সাথে তার নিবিড় যোগাযোগ ছিল। এফ-১৬ বিমানের বিষয়ে সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে তাদের ভূমিকা ছিলো,’ বলছিলেন মুখপাত্র ইয়ুরি ইনহাট।
‘যুদ্ধের সময়ে তিনি পশ্চিমা গণমাধ্যমে সাক্ষাতকার দিয়েছেন অনেক, কারণ তিনি ভালো ইংরেজি জানতেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার আলোচনার বিষয়। সেটি হলো ইউক্রেনের জন্য কোনটি নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার।’
তিনি বলেন, আন্দ্রি পিলশচিকভ শুধু একজন পাইলট ছিলেন না। তিনি মেধাবী ও জ্ঞানী একজন তরুণ অফিসার ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন চমৎকার যোগাযোগকারী।
বিমান বাহিনীর এয়ারক্রাফট সংস্কারের মূল চালক যিনি বহু প্রকল্পে অংশ নিয়েছেন। আমি প্রায়ই তার আইডিয়াকে সমর্থন করতাম কারণ সেগুলো সত্যিই চমৎকার ফল এনে দিতো।
ইউক্রেনের মিত্র দেশগুলো থেকে তৈরি ১১ জন সদস্যের একটি প্রশিক্ষক দল এই মাসের শেষদিকে ইউক্রেনের পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করবে। আগামী বছরের মধ্যে তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আসন্ন শীত ও শরৎ ঋতুর মধ্যে কিয়েভ এফ-১৬ ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হতে পারবে না বলে এ সপ্তাহে মন্তব্য করেছিলেন ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইউরি ইহনাত।
ইউক্রেনে ২০২২ সালে পুরোদমে সেনা অভিযান শুরু করা রাশিয়া এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি।
ইউক্রেন বলছে, তারা দেড় শ’ পাইলটকে চিহ্নিত করে রেখেছে, এফ-১৬ বিমান পাওয়ার সাথে সাথেই যেন তাদের প্রশিক্ষণ শুরু করে দেয়া যায়।
কিন্তু এফ-১৬ চালানোর প্রশিক্ষণ বেশ দীর্ঘমেয়াদী এবং এসব পাইলটকে তখন যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে লম্বা সময়ের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে চলে যেতে হবে।
এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন
‘এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন’ যুদ্ধবিমানকে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ফাইটার জেট হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সত্তরের দশকে এই বিমানটি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজারের মতো এফ-১৬ তৈরি করা হয়েছে।
ভূ-পৃষ্ঠে লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত করা ও আকাশে প্রতিপক্ষের বিমান ধ্বংস করায় পারদর্শিতার কারণে পাইলটদের কাছে জনপ্রিয় এটি।
একবার জ্বালানি নিয়ে এই বিমান যুতটুকু পথ পাড়ি দিতে পারে, একই ধরনের অন্য যেকোনো বিমানের তুলনায় তা সর্বোচ্চ। অর্থাৎ, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের বিমানের চেয়ে বেশি সময় অবস্থান করতে পারে এটি।
যেকোনো আবহাওয়া পরিস্থিতিতে, এমনকি রাতেও এই বিমান যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকর। ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার কারণে মার্কিন পাইলটরা এটিকে ‘ভাইপার’ নাম দিয়েছেন।
আমেরিকার বিমান বাহিনীর কাছে এই মুহূর্তে ৭০০টি কার্যকর এফ-১৬ রয়েছে। ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসসহ অনেক দেশই এটি ব্যবহার করে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, এই বিমানকে নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সম্ভব, এমন প্রেসিশন গাইডেড মিসাইল ও বোমা দিয়ে সজ্জিত করা যায়। এই বিমান ঘণ্টায় ১ হাজার ৫০০ মাইল বেগে ছুটতে পারে।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply