ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে সাম্প্রতিক দাঙ্গার পরে গত এক সপ্তাহে নূহ ও গুরগাঁও থেকে বহু মুসলমান সরে গেছে। তাদের একটা বড় অংশই পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার থেকে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিক।
তারা বলছে, প্রথমে নূহতে দাঙ্গা, তারপরে গুরগাঁও ও এর-সংলগ্ন মসজিদে হামলা, এক ইমামকে হত্যা এবং সর্বশেষে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি- সব মিলিয়ে গুরগাঁওকে নিরাপদ বলে মনে করছে না তারা। তবে পশ্চিমবঙ্গ বা বিহার থেকে যাওয়া আরো বহু শ্রমিক এখনো গুরগাঁওতেই রয়ে গেছে।
বৃহস্পতিবার, ১০ আগস্ট সকালে যখন আমি তাকে ফোনটা করি, তখন তিনি পরিবার, প্রতিবেশী ও আরো ১২ জনের সাথে পশ্চিমবঙ্গের মালদা রেল স্টেশনে নেমেছেন। তার ফোন নম্বরটা সংগ্রহ করেছিলাম গুরগাঁওতে তারই এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর প্রথমেই অনুরোধ করলেন, তার নামটা যেন প্রকাশ না করি।
তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে আবারো তো আমাদের ফিরতে হবে গুরগাঁওতেই, তাই নামটা দয়া করে প্রকাশ করবেন না।’
তিনি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বুনিয়াদপুর অঞ্চলের আদি বাসিন্দা। গুরগাঁওতে গত ১০ থেকে ১২ বছর ধরে গাড়িচালকের কাজ করেন তিনি।
‘নামাজ পড়তে যেতে পারিনি এই ক’দিন’
তিনি বলেন, ‘১ আগস্ট রাতে গুরগাঁওয়ের যে মসজিদের নায়েব ইমাম মুহম্মদ শাদকে দাঙ্গাকারীরা হত্যা করেছিল, ওই মসজিদের কাছেই আমার বাসা। খবরটা পাওয়ার পরে সারারাত ঘুমাতে পারিনি।’
বেশ কয়েকটা দিন আতঙ্কের মধ্যে কাটিয়ে শেষে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ওই ব্যক্তি।
তিনি বলছিলেন, ‘তবে আমার বাড়ির মালিক স্থানীয় জাঠ সম্প্রদায়ের মানুষ। যে রাতে গণ্ডগোল চলছে, তিনি আমাদের সাহস যোগাতে তার স্ত্রীকে নিয়ে নিজেই চলে এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। কিন্তু নানা দিক থেকে খবর পাচ্ছিলাম যে রাস্তাঘাটে আটকাচ্ছে, আধার কার্ড পরীক্ষা করা হচ্ছে। নামাজ পড়তে যেতে পারিনি ওই ক’দিন। এই অবস্থায় আপাতত ফিরে আসাই উচিত হবে বলে মনে হয়েছে আমাদের।’
ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা অবশ্য সহিংসতার দিনেই নিয়ে ফেলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার বাসিন্দা জাকির।
তিনি ছোট থেকেই গুরগাঁওতেই থাকেন আর প্রথম ব্যক্তির মতোই গাড়িচালকের কাজ করেন।
তার বাড়ি সেক্টর ৫৭-তে, যে মসজিদের নায়েব ইমামকে হত্যা করা হয়েছে, তার খুব কাছে।
তিনি বলেন, ‘ওই মসজিদেই তো নিয়মিত নামাজ পড়তে যেতাম। ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে নামাজ পড়ে বাসায় ফিরি, আর রাত ৩টার দিকে ফোন পাই যে এত বড় ঘটনা হয়ে গেছে মসজিদে। সকালে মসজিদের দিকে তো যেতেই পারলাম না, এত পুলিশ। কিন্তু তারা যে আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে, ওই ভরসা তো আর রইল না। সারাদিন ভীষণ আতঙ্কে কাটিয়েছি, যদি আরো বড় কোনো অশান্তি হয়। ওই দিন রাত সাড়ে ৮টা-৯টার দিকে ট্যাক্সি নিয়ে দিল্লি গিয়ে বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরি।’
‘ওরা জিজ্ঞাসা করেছিল যে আমি হিন্দু না কি মুসলমান’
তবে ৫৫-৫৬ সেক্টরের ঘাটাগাঁওতে থাকেন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বাসিন্দা জুল হাসান। আতঙ্কে থাকলেও তিনি এলাকা ছাড়েননি। তিনি বছর ১৫ ধরে গুরগাঁওতে থাকেন আর দিনমজুরি করে রোজগার করেন।
তিনি বলছিলেন, ‘টেনশন তো আছেই, কী হয়, ওই দুশ্চিন্তা আছে। তার মধ্যেই সাহস করে থাকছি। তবে আমাদের এই জুগ্গি-ঝোপড়ির (বস্তিকে দিল্লি অঞ্চলে জুগ্গি-ঝোপড়ি বলা হয়) বহু বাঙালী-বিহারী ফিরে গেছে। হাজার দুয়েক মানুষ থাকে এখানে, এখন রয়েছে তিন-চার শ’ লোক।’
গত এক সপ্তাহে গুরগাঁওয়ের বাসিন্দা এক বাঙালী শ্রমিক দিল্লি স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ দিনাজপুরের ওই ব্যক্তি বলছিলেন, ‘স্টেশনে এত বাঙালী যে কোথাও কোনো হিন্দি কথাই শোনা গেল না। সবাই তো বাংলায় কথা বলছে। তাহলেই বুঝে নিন যে কত মানুষ প্রতিদিন ফিরে আসছে।’
এই দু’জনকে সরাসরি গুরগাঁও ছাড়ার হুমকি দেয়নি কেউ, তবে মসজিদে হামলা আর নায়েব ইমামকে হত্যার কয়েক দিন পরেই গুরগাঁওয়ের সেক্টর ৭০-এ বিবিসি হিন্দির সংবাদদাতা সেরাজ আলির সঙ্গে দেখা হয়েছিল আকলিমা নামে এক নারীর, যাকে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা সরাসরি শহর ছাড়ার হুমকি দিয়েছিল।
আকলিমা জানিয়েছিলেন, ‘ওরা জিজ্ঞাসা করেছিল যে আমি হিন্দু না কি মুসলমান। আমি তাদের জানাই যে আমি মুসলমান, তখনই তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা আমাকে বলে যে শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে বিকাল ৪টার মধ্যে।’
ওই সেক্টর ৭০-এ অভিবাসী শ্রমিক বস্তিগুলোতে গিয়ে এলাকা ছাড়ার হুমকি দিয়েছিল বলে জানা গেছে। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন না যে অভিবাসী শ্রমিকরা এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘কেউই এলাকা ছেড়ে যায়নি, সবাই নিজের জায়গাতেই আছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এলাকায় টহল বাড়ানো হয়েছে।’
আতঙ্কে আছে হিন্দু বস্তিবাসীরাও
গুরগাঁওতে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর ঝাঁ চকচকে দফতর বা দেশী-বিদেশী নামী-দামী ব্র্যান্ডের আউটলেটে ভরা শপিং মল অথবা কোটি কোটি টাকা মূল্যের গগনচুম্বী আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট ভবন- সব ক্ষেত্রেই পরিষেবা প্রদান করে থাকে মূলত অভিবাসী শ্রমিকরাই। তাদের বেশিরভাগ মুসলমান হলেও হিন্দু শ্রমিকদের সংখ্যাও কম নয়।
তাই বাদশাপুর শ্রমিক বস্তিতে তাই দেখতে পাওয়া যায় রাজমিস্ত্রী রহমান আর রঙমিস্ত্রী রঞ্জিত বা শ্রমিক তাপস পাশাপাশি ঘরেই বাস করেন। একটা বড় সংখ্যক মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিক আতঙ্কে গুরগাঁও ছেড়ে চলে গেলেও হিন্দু শ্রমিকরাও ভয়ে রয়েছে।
ওই বস্তির বাসিন্দা রঙমিস্ত্রী রঞ্জিতের কথায়, ‘যদি পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়, তাহলে আমিও ফিরে যাওয়ার কথা ভাবব। এখন তো বড় রাস্তায় যেতেই ভয় হয় আমার।’
আরেক হিন্দু বাসিন্দা তাপস বলছিলেন, ‘আমরা চাই পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হোক, যেন আমি আবারো কাজে যেতে পারি। আমরা সবাই এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি, তাই যত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, ততই মঙ্গল।’
কোথাও আধার কার্ড পরীক্ষা করা বা কোথাও এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি- এই আতঙ্কে যেসব অভিবাসী শ্রমিক গুরগাঁওতে থেকে গেছে, তাদের একটা বড় অংশই কাজে যেতে পারছে না। আর যারা পশ্চিমবঙ্গ বা বিহারে ‘দেশের বাড়িতে’ ফিরে গেছেন, তারা তো কাজের জায়গায় অনুপস্থিত থাকছেই।
এসব জায়গায় ‘হাউসকিপিং’ বা সাফাইয়ের কাজ করে মূলত অভিবাসী শ্রমিকরাই। আবার অনেক ছোট বড় দোকানেও মূল চালিকা শক্তি শ্রমিকরাই। এর ফলে সমস্যায় পড়ছে অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আর আবাসিক কমপ্লেক্সগুলো।
জঞ্জাল পরিষ্কার হচ্ছে না, চুল কাটার লোক নেই
গুরগাঁওয়ের সেক্টর ৭০-এ মুসলমানদের এলাকা ছাড়ার হুমকি দেয়া হয়েছিল, ওই অঞ্চলেরই একটি বহুতল আবাসিক কমপ্লেক্সের রেসিডেন্টস ওয়েলফেয়ার কমিটি (আরডব্লিউএ) বা অধিবাসী উন্নয়ন সমিতির সভাপতির একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যেখানে তিনি বলছেন যে তাদের সাফাই-কর্মীরা আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন, ফলে আবাসনের জঞ্জাল পরিষ্কার করার লোক নেই।
আরডব্লিউএয়ের সভাপতি কিরণ কাপুরকে ওই ভাইরাল ভিডিওতে বলতে শোনা যাচ্ছে, তাদের আবাসিক কমপ্লেক্সের বেসমেন্টে দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। প্রত্যেক ফ্ল্যাটের সামনে জঞ্জাল জমছে। গৃহ-পরিচারিকারা আসছে না, সেটা না হয় আমরা সামলিয়ে নিতে পারব, বাসন মাজা ধোয়া করে নিতে পারব। কিন্তু জঞ্জাল কে ফেলে আসবে বলুন তো, সেটা কি করা সম্ভব?’
প্রশাসনের কাছে তিনি এই আর্জিও জানিয়েছেন, যেন সাফাই-কর্মীদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা দেয়া হয়, যেন তারা কাজে ফিরে আসতে পারে।
‘দ্য কুইন্ট’ সংবাদ পোর্টাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে তারা বলছে, কাপুর যে আবাসিক কমপ্লেক্সে থাকেন, সেখানকার ১২ জন সাফাই-কর্মীর মধ্যে ১০ জনই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান আর তাদের মধ্যে আটজন বিগত কয়েকদিনে গুরগাঁও ছেড়ে চলে গেছে।
ওই পোর্টালটি আরা একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছে তাদের প্রতিবেদনে, যেখানে একটি জনপ্রিয় সেলুন তার গ্রাহকদের কাছে মেসেজ পাঠিয়ে বলেছে যে ‘সাম্প্রতিক ঘটনার কারণে’ তারা কর্মী স্বল্পতার সমস্যায় পড়েছে। ওই সেলুনের মালিকদের একজন ‘দ্য কুইন্ট’কে জানিয়েছেন যে তাদের সংস্থায় যারা চুল-দাড়ি কাটেন তাদের বেশিরভাগই মুসলমান।
‘বিভিন্ন আবাসিক কমপ্লেক্সে সমস্যা হচ্ছে’
বিবিসির সহকর্মী সৌতিক বিশ্বাস গুরগাঁওতেই থাকেন। তিনি জানাচ্ছেন, হাউসকিপিং বা সাফাই কর্মচারী, গৃহপরিচারিকা আর নির্মাণ শিল্পের বেশিরভাগ শ্রমিকই অভিবাসী।
তার কথায়, ‘তাদের অনেকেই চলে যাওয়ায় বিভিন্ন আবাসিক কমপ্লেক্সে সমস্যা হচ্ছে বলে জানতে পারছি। বেশ কিছু ঘটনা হয়েছে যার জন্য আতঙ্কে অনেক শ্রমিকই গুরগাঁও ছেড়ে চলে গেছেন। হয়তে পুরো শহরের জনসংখ্যা বা অভিবাসী শ্রমিকদের সংখ্যার অনুপাতে ফিরে যাওয়া শ্রমিকদের সংখ্যাটা এখনো খুব বড় নয়। কিন্তু এখানে কতজন চলে গেছে আর কতজন রয়ে গেছে, ওই সংখ্যাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। ঘটনাগুলো প্রতীকী, আজ হয়তে কম সংখ্যক মানুষ আতঙ্কে গুরগাঁও ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু পরে এমনই কোনো ঘটনায় আরো বেশি যে হুমকি দেয়া হবে না বা আরো বেশি সংখ্যক মানুষ যে হুমকির মুখে আতঙ্কে গুরগাঁও ছেড়ে যাবে না, তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে?’
তিনি বলেন, ‘এই সব অভিবাসী শ্রমিকদের যে মহল্লাগুলো রয়েছে, সেগুলো সবই স্থানীয় গ্রামবাসীদের জমি, তারাই সেখানে শ্রমিকদের ঘর ভাড়া দেয়। তাই শ্রমিকরা চলে গেলে তাদের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। ফলে অনেক জমি মালিক তাদের জুগ্গি-ঝোপড়িতে থাকা অভিবাসীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে যে তারা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে, তারা কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর সাথে কথা বলবে ইত্যাদি।’
জাঠ বাড়ির মালিকরা যে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে, সেটা বলছিলেন এই প্রতিবেদনের শুরুর দিকে উদ্ধৃত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ দিনাজপুরের ওই মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিকও, যিনি ১০ আগস্ট দিল্লি থেকে মালদা স্টেশনে এসে নেমেছেন।
ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে
নূহের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বা গুরগাঁওয়ের মসজিদের নায়েব ইমাম হত্যার পরে কেটে গেছে দিন দশেক। পুলিশ প্রশাসন মসজিদটি পরিষ্কার আর মেরামতির জন্য হস্তান্তর করে দিয়েছেন মসজিদ কমিটির কাছে। যদিও এখনো দলে দলে বাঙালী বা বিহারী মুসলমানদের বাড়ি ফিরে যাওয়া বন্ধ হয়নি। তবে স্থানীয় মুসলমান নেতৃত্ব বলছেন, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।
যে মসজিদের নায়েব ইমামকে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানেই নিয়মিত নামাজ পড়তে যান এমন একজন নেতৃস্থানীয় মুসলমান বলছিলেন, ‘যারা চলে গিয়েছিল, তাদের কেউ কেউ আবার ফিরতে শুরু করেছে। আমরাও পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে ভরসা পাচ্ছি নিরাপত্তার। সংবেদনশীল এলাকাগুলোতে পুলিশের টহলদারিও বাড়িয়েছে।’
যেসব অভিবাসী শ্রমিকের সাথে কথা বলা হয়েছে, তারাও বলছে যে কাজের জন্য ফিরতে তাদের হবেই গুরগাঁওতে, তবে সেটা কত দিনে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউই।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply