মুসলমানদের স্বতন্ত্র বর্ষপঞ্জির নাম হিজরি বর্ষপঞ্জি বা হিজরি সন। একমাত্র হিজরি সনই বর্তমান বিশ্বের সব তাওহিদবাদী জনতার কাছে সমানভাবে সমাদৃত, অতি পবিত্র, মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ বর্ষপঞ্জি।
হিজরি সনের সম্পর্ক চন্দ্রের সাথে। আমরা জানি, পৃথিবীতে বর্ষ গণনার দুটো ধারা প্রচলিত আছে। যার একটির সম্পর্ক সূর্যের গতির সাথে, আর অন্যটির সম্পর্ক চাঁদের গতির সাথে। প্রথমটির নাম সৌরবর্ষ আর দ্বিতীয়টির নাম চন্দ্রবর্ষ। এই দুটো সালের মধ্যে প্রতি বছর ব্যবধান হয় ১০ কিংবা ১১ দিনের। সৌর সনের বছর হয় মোটামুটি ৩৬৫ দিনে, আর চন্দ্র সনের বছর হয় ৩৫৪ দিনে। কোনো বিশেষ ঘটনার স্মৃতি ধরে রাখার মন-মানসিকতা, তারিখ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা এবং দিন-মাস-বছর গণনার জোর তাগিদ থেকে মানবসভ্যতার শুরু থেকেই পঞ্জিকার উদ্ভব ঘটেছে, উদ্ভব ঘটেছে সন বা সালের। বাংলাদেশে বর্তমানে হিজরি সন, ইংরেজি সাল ও বাংলা সনের প্রচলন রয়েছে।
হিজরি সনের উৎপত্তি : ১৭ হিজরি সন মোতাবেক ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের শাসক হজরত ওমর ফারুক রা:-এর শাসন আমলে হিজরি সন গণনা শুরু হয়। ঐতিহাসিকদের অভিমত হলো, ওই বছর প্রথম হিজরির ১ মহররম পড়েছিল ১৬ জুলাই, ৬২২ সাল রোজ জুমাবার। এটিই হচ্ছে হিজরি সন প্রবর্তনের সূচনাকাল (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/৫১৭)।
বিশ্বের কোটি মুসলমানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জীবনধারার সাথে মিশে আছে হিজরি সন। অতীতে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায় নানা উপলক্ষ ঘিরে সন তারিখ গণনার সুবিধার্থে বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করে তা অনুসরণ করে এসেছে। মুসলমানরা ফরজ বিধান পালনে ও নানা আচার-উৎসব উদযাপনের ক্ষেত্রে হিজরি সন তথা চন্দ্র মাসকে অনুসরণ করে থাকে। চাঁদের উদয়ের ভিত্তিতে মুসলমানদের ইবাদত ও ধর্মীয় বিভিন্ন দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়।
মুসলমানদের সোনালি যুগে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর ফারুক রা:-এর বিশেষ আগ্রহ ও ভূমিকায় হিজরি সন প্রবর্তিত হয়। খোলাফায়ে রাশেদার শাসনকালে মদিনাকেন্দ্রিক নগর রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন হলে অফিসিয়াল তথ্যাদি ও নথিপত্র আদান-প্রদানের দিনক্ষণের হিসাব রাখতে গিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নর অসুবিধায় পড়েন। যেহেতু তখন ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো বর্ষপঞ্জি বা একক সন চালু ছিল না।
রাষ্ট্রীয় অফিসিয়াল কার্যাদি নির্বিঘে ও যথানিয়মে সম্পন্ন করার প্রয়োজনে নতুন সন প্রবর্তন তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর এই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বিভিন্ন প্রদেশের দায়িত্বশীল পদস্থ ব্যক্তিরা একের পর এক তাগাদা ও পরামর্শ দিতে থাকেন খলিফা হজরত ওমর ফারুক রা:-কে।
সে সময়ের ইরাক ও কুফার গভর্নর হজরত আবু মূসা আশয়ারি রা: খলিফা হজরত ওমর ফারুক রা:-এর কাছে একটি চিঠিতে লিখলেন- ‘বিশ্বাসীদের নেতা, আপনার পক্ষ থেকে আসা শাসন কার্যের সাথে, পরামর্শ এবং নির্দেশসংবলিত বিভিন্ন চিঠিপত্র ও দলিলে কোনো সন-তারিখ না থাকায় আমরা তার সময় ও কাল নির্ধারণে যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হই। অধিকাংশ সময় এসব নির্দেশনার সাথে পার্থক্য করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে বলে আপনার নির্দেশ ও উপদেশ পালন করতে গিয়ে আমাদেরকে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে।’ বিভিন্ন সময় এ ধরনের অভিযোগ ও সমস্যার কথা শুনে খলিফা হজরত ওমর রা: শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম রা: ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যক্তিদের সাথে বিশেষ বৈঠকে মিলিত হন (ইবনুল আসির, আল-কামিল ফিত-তারিখ-১/৮)।
আলাপ-আলোচনায় একটি বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের ওপর সবাই মতৈক্যে পৌঁছলেও কখন থেকে কী নামে বর্ষপঞ্জি করা হবে তা নিয়ে নানা মত ব্যক্ত করেন সাহাবায়ে কেরাম রা:। কেউ বললেন, রাসূল সা:-এর জন্ম দিবসের দিন ধরে বর্ষগণনা শুরু করতে, কেউ অভিমত দিলেন প্রিয় নবী সা:-এর নবুয়ত প্রকাশের বছর থেকে, কেউ বললেন নবীজী সা:-এর ওফাতের দিন থেকে, আবার কেউ পরামর্শ দিলেন মহানবী সা:-এর মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরতের দিন থেকে বর্ষগণনা শুরু করা যায়। গণতান্ত্রিক উপায়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা ও যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শেষে অবশেষে রাসূল সা:-এর হিজরতের ঘটনাকে মহিমান্বিত করার জন্য মহররম মাস থেকে হিজরি নামে একটি স্বতন্ত্র সন চালু করার ঘোষণা দেন ওমর ফারুক রা:। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শ’ বছর ধরে হিজরি সন মুসলমানদের জীবনধারার সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। হিজরি সন হয়ে উঠেছে তাদের গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতীকরূপে। বাংলা ও খ্রিষ্টীয় সন যেমন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনধারার বড় অনুষঙ্গ, তেমনি হিজরি সনকে আমরা অনুসরণ করে থাকি ইসলামী নানা দিবস ও আচার অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে।
মুসলিম বিশ্বে চাঁদের হিসাবে অনেক ইবাদত-বন্দেগি, আমল-অনুশাসন পালিত হওয়ায় হিজরি সনের পবিত্র মাহাত্ম্য ও প্রাচুর্য প্রত্যেক মুসলিমের অন্তরজুড়ে সমানভাবে বিশেষ মর্যাদায় সমাসীন রয়েছে। মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আওয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ- এই ১২ মাস নিয়ে হিজরি সন।
লেখক :
শিক্ষাবিদ ও গবেষক
Leave a Reply