বৈদেশিক কল আদান-প্রদান এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধার জন্য চার বছর আগে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। ৩৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। তবে ‘ডিজিটাল কানেক্টিভিটি শক্তিশালীকরণে সুইচিং ও ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ (এসটিএন) প্রকল্পটির শুরুতেই দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের দরপত্রে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর তদন্ত শুরু করে দুদক।
ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিটিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রফিকুল মতিনসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলারও সুপারিশ করেছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা। বাকি অভিযুক্তরা হলেন- বিটিসিএলের সাবেক ডিএমডি মো. রফিকুল ইসলাম (বর্তমানে মহাপরিচালক, টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর), ডিএমডি (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) একেএম হাবিবুর রহমান, ডিএমডি (অর্থ) খন্দকার যুবায়ের হাসান ও সাবেক উপ-সচিব (ডাক-২) এবিএম বদিউজ্জামান। দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন অনুযায়ী,
২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। একই বছরের ১০ জুন এসটিএন প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের দরপত্র দলিল ও দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ব্যয় প্রস্তুতের জন্য একটি কমিটি করা হয়। কমিটির তৈরি প্রাক্কলন নিজে অনুমোদন করেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। একই বছরের ১২ ডিসেম্বর এ প্রকল্পের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়।
২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচটি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। সাত সদস্যের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সর্বসম্মতিক্রমে মেসার্স এক্স-ফার লিমিটেডকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ও সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ঘোষণা করে এবং দাখিল-উত্তর যাচাই সম্পন্ন করে। দুদকের অনুসন্ধান বলছে, কমিটিতে থাকা সরকারি কর্মকর্তারা প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে মূল্যায়ন প্রতিবেদনের বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা নম্বর হাতে কেটে অতিরিক্ত দুই পাতা সংযোজন করে পুনঃদরপত্রের ভিন্ন মত দেন। বিষয়টি গোপন করতে বোর্ডসভায় মূল্যায়ন প্রতিবেদন ছাড়া শুধু কার্যপত্র উপস্থাপন করা হয়। সভায় কমিটির সব বহিঃসদস্য দরপত্র বাতিলের বিপক্ষে এবং সরকারি কর্মকর্তারা বাতিলের পক্ষে মত দেন। এরপর সেই অনুযায়ী বোর্ডসভায় দরপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দুদক বলছে, কর্মকর্তারা অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, বিধি ও দরপত্র দলিলের শর্ত লঙ্ঘন করেছেন।
দরপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে বিটিসিএলের রিভিউ প্যানেলে আবেদন করে কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠান এক্স-ফার লিমিটেড। রিভিউ নিষ্পত্তির আগেই একই বছরের ২০২০ নভেম্বরে পুনঃদরপত্র আহ্বান করে বিটিসিএল। পরবর্তী সময় আরও দুবার দরপত্র আহ্বান করার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য দরপত্র স্থগিত করা হয়।
এই অনিয়মের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ কোনো সরকারি অর্থ আত্মসাৎ হয়নি উল্লেখ করে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, এর ফলে বিটিসিএলের উল্লিখিত কর্মকর্তারা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধি ভঙ্গ করে দরপত্র বাতিল করায় নির্ধারিত সময়ে, এমনকি অদ্যাবধিও কার্যাদেশ প্রদান সম্ভব হয়নি। যার ফলে সরকারের গৃহীত প্রকল্পের সুফল প্রাপ্তি থেকে জনগণ বঞ্চিত হয়েছে এবং সরকারও বড় অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক নারগিস সুলতানা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন-২০০৬-এর ৬৪(৩) ধারা এবং বিধিমালা-২০০৮ এর বিধি-১২৭ লঙ্ঘনের পাশাপাশি প্রতারণা ও জালিয়াতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনে দ-বিধির ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/১০৯ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলা রুজুর সুপারিশ করেছেন। প্রতিবেদনটি দুদকের আইন অনুবিভাগের মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছে।
বিটিসিএলের এসটিএন প্রকল্প সংক্রান্ত অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নারগিস সুলতানা বলেন, ‘আমার ওপর যে দায়িত্ব ছিল তা শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করেছি। এ বিষয়ে কোনো কিছু জানতে হলে জনসংযোগ অফিস থেকে জানতে হবে।’ দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেকের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘অনুসন্ধান প্রতিবেদন নিয়ে কিছু বলার সুযোগ নেই। যদি কমিশন থেকে সিদ্ধান্ত আসে তাহলে জানানো যাবে।’
Leave a Reply