ব্যাংকগুলোর ডলার সঙ্কট ও নানা বিধিনিষেধের কারণে আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। বিপরীতে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি খুব বেশি না বাড়লেও ঋণাত্মক হয়নি। এর ফলে ডলারের চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে আসছে। কিন্তু পণ্য আমদানির পুরনো দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে যে পরিমাণ ডলারের প্রয়োজন হচ্ছে ওই পরিমাণ ডলার সরবরাহ হচ্ছে না। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে এ ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছে। বিদায়ী বছরে ১৩.৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে। এর ফলে সামগ্রিক হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) ডলারের সামগ্রিক হিসাবের ঘাটতি বেড়েছে সাড়ে ৫৭ শতাংশ। চলমান অবস্থার উন্নতি না হলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আরো কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম এগার মাসে (জুলাই-মে) আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৯ শতাংশ। এ হিসাবে এক বছরে পণ্য আমদানি কমেছে প্রায় ৫৩ শতাংশ। আমদানি কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর ডলার সঙ্কট চলমান রয়েছে। সেই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া বিলাসজাত পণ্য ও অন্যান্য পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছিল শতভাগ মার্জিন ছাড়া এলসি খোলা যাবে না। অর্থাৎ কোনো গ্রাহক ১০০ টাকার পণ্য আমদানি করতে হলে শতভাগ অর্থই আগে পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে পণ্য আমদানি কমে যায়। অপর দিকে ডলার সঙ্কটের কারণে যেসব এলসির দায় পরিশোধ করতে হতো ক্ষেত্রবিশেষে তার মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া হয়। এর ফলে সামগ্রিক এলসির দায় কমে যায়।
এ দিকে, পণ্য আমদানিতে ব্যয় কমলেও রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি সামান্য হলেও বেড়েছে; ঋণাত্মক হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ, সেখানে বিদায়ী অর্থবছরে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৬৭ শতাংশ। অপর দিকে, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে বিদায়ী অর্থবছরে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আমদানি ব্যয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির কারণে চলতি হিসাবের ঘাটতিও কমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) চলতি হিসাবের ঘাটতিক ছিল ১ হাজার ৭২৮ কোটি ডলার, সেখানে বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে তা কমে হয়েছে ৪৫০ কোটি ৮০ লাখ ডলারে।
চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে আসলেও ডলারের সামগ্রিক হিসাবের ঘাটতি কমছে না বরং দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, আগের বছরের ১১ মাসে সামগ্রিক হিসাবের ঘাটতি যেখানে ছিল ৫৫৯ কোটি ডলার, সেখানে বিদায়ী অর্থবছরের আলোচ্য সময়ে এ ঘাটতি সাড়ে ৫৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৮৮০ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে এলেও সামগ্রিক হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, যে পরিমাণ পণ্য রফতানি হচ্ছে ওই পরিমাণ রফতানি আয় দেশে আসছে না। এতে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। আগের অর্থবছরের ১১ মাসে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে যেখানে উদ্বৃত্ত ছিল ১ হাজার ৩৩৭ কোটি ডলার, সেখানে বিদায়ী অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি হয়েছে ২৫৮ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। অপর দিকে, পণ্য আমদানির যেসব দায় বকেয়া রাখা হয়েছিল তা এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে।
সবমিলে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে ওই পরিমাণ সরবরাহ হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে ঘাটতি মেটাতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হয়েছে সাড় ১৩ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। যেখানে আগের বছরে বিক্রি করতে হয়েছিল সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ প্রতিনিয়তই কমে যাচ্ছে। ২০২২ সালের ৩০ জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ যেখানে প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার ছিল সেখানে বিদায়ী অর্থবছরের শেষ দিনে তা কমে নেমেছে ৩১ বিলিয়ন ডলার। আকুর দায় পরিশোধ করায় তা এখন ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চলমান পরিস্থিতি উন্নতি না হলে সামগ্রিক হিসাবের ঘাটতি বাড়তেই থাকবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আরো কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
Leave a Reply