লিবিয়ার বেনগাজিতে তালাবদ্ধ থাকার সময় মানবপাচারকারীদের গুলিতে নিহত হওয়ার চার দিন আগে ভাই তোফাজ্জল হোসেনের (২২) সাথে মোবাইলে আমার কথা হয়েছে। তখন ভাই কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলছিল, ওরা আমাদেরকে ভয়ঙ্কর নির্যাতন করছে। তোমরা যদি আমাকে বাঁচাতে চাও তাহলে দ্রুত দুবাইয়ে সোমালিয়া ব্যাংকের নামে ১২ হাজার ইউএস ডলার পাঠাও। নতুবা মাফিয়ারা আমাকে মেরে ফেলবে।
লিবিয়ায় গত বৃহস্পতিবার ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনার বিষয়ে হবিগঞ্জ জেলার দুর্গাপুর বুমচি গ্রামের বাসিন্দা কাউছার তালুকদার গতকাল শনিবার সন্ধ্যার আগে এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এসব একথা বলেন। তিনি বলেন, গুলিতে যে ২৬ জন মারা গেছে তার মধ্যে আমার ভাইয়ের বন্ধু যশোরের আব্দুর রহমানের নাম দেখছি। আমার ভাই তার সাথেই এক রুমে থাকত। নিহতের তালিকায় তার কোনো নাম পাচ্ছি না। তাহলে আমার ভাই কোথায়? মারা গেছে নাকি জীবিত আছে তাও আমরা জানতে পারছি না।
কাউছার তালুকদার গতকাল নয়া দিগন্তকে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানিয়ে বলেন, গত বছরের ২০ রমজানে দুবাই হয়ে লিবিয়ার বেনগাজিতে গিয়েছিল আমার ভাই। সেখানেই সে টুকটাক কাজ করত। এর মধ্যেই ১৫ দিন আগে আমার ভাইসহ ২০ জন মাফিয়াদের হাতে জিম্মি হয়। জিম্মি অবস্থায় তাদেরকে দিনে একবার খাবার দিত। টাকার জন্য মারধর করত। দালাল দিয়ে এক মিনিটের জন্য টেলিফোনে কথা বলাত। ওই সময় বাংলাদেশী দালাল নাম না বলে শুধু বলত, ১২ হাজার ইউএস ডলার না দেয়ায় দু’জনকে খুন করে তোর ভাইয়ের সামনেই লাশ ফেলে রাখা হয়েছে। ডলার দ্রুত না পাঠালে তোর ভাইকেও একই পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে আমাকে হুমকি দেয়া হয়। তিনি বলেন, আমি দালালকে বলেছি, দেশে লকডাউনের কারণে আমরা ঘর থেকে বের হতে পারছি না। ঈদের পর আমরা ১২ হাজার ডলার না পারি ২/৩ লাখ টাকা পাঠাব। কিন্তু যেদিন তাদের হত্যা করা হয় তার আগের রাতে আব্দুল্লাহ নামের বাংলাদেশী দালাল আমাদের জানায়, তোমার ভাইরা তো ঘটনা ঘটিয়ে দিয়েছে। তারা সবাই মিলে মাফিয়া গ্রুপের একজনকে মেরে ফেলেছে। এখন কি হয় কে জানে বলে টেলিফোন রেখে দেয়। এরপর থেকে ওই দালালও আর টেলিফোন ধরছে না।
এক প্রশ্নের উত্তরে কাউছার বলেন, আমার ভাই ও যশোরের আব্দুর রহমান একই রুমে ছিল। কিডন্যাপাররা তাদের বাইরে থেকে তালা মেরে রাখত। আব্দুর রহমান মারা গেলে তাহলে আমার ভাই কোথায়? তিনি বলেন, কিডন্যাপাররা আমার ভাইসহ যে ২০ জনকে জিম্মি করেছিল তাদের জন্য মোট ২ কোটি টাকা দাবি করেছিল দালাল। তবে তিনি দাবি করেন, আমার ভাই ইউরোপে নয়, বেনগাজি থেকে ত্রিপোলি যাচ্ছিল একটু ভালো কাজের আশায়। এমনিতেই বেনগাজিতে টুকটাক কাজ সে করছিল। সেখানকার পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হওয়ার কারণে সেসহ অন্যরা বেনগাজি থেকে ত্রিপোলিতে যাওয়ার সময় পথে মাফিয়াদের হাতে অপহরণের শিকার হয়।
উল্লেখ্য গত বৃহস্পতিবার রাতে দুই লিবিয়ান নাগরিক হত্যার প্রতিশোধ নিতে স্থানীয় বিদ্রোহী সরকারের সন্ত্রাসী মাফিয়া গ্রুপের সদস্যরা এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে ৩৭ বাংলাদেশী হতাহত হয়। এদের একজন কোনো রকমে পালিয়ে লিবিয়ান একজনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এসময় গুলিবিদ্ধ হয় মোট ১১ জন। তারমধ্যে ৬ জন সুস্থ হলেও ৫ জনের অবস্থা গুরুতর। তাদের প্রথমে ত্রিপোলি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাদের জারাবা নামক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
গতকাল লিবিয়ার ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর (শ্রম) এ এস এম আশরাফুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত নিহত ২৩ জনের পরিচয় ছবির সাথে মিলিয়ে শনাক্ত করতে পেরেছি। বাকি ৩ জনের পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি। অপরদিকে হাসপাতালে আহত ৫ জনের মধ্যে থেকে গুরুতর ৩ জনকে জারাবা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে আজ।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে পুরো লিবিয়াই একটা যুদ্ধক্ষেত্র। বেনগাজির ২০০ কিলোমিটারের পুরোটাই ভয়ঙ্কর অবস্থা। সেখানে কারো যাওয়ার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় নিহত বাংলাদেশীদের লাশ বেনগাজিতেই দাফন করা হবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এ দেশের যে পরিস্থিতি তাতে ২ মাসের বেশি লাগতে পারে বিমান চলাচল শুরু হতে। তাই লাশগুলো এখানেই দাফন করা হবে। তিনি বলেন, লাশ দাফনেও বাধা সৃষ্টি করতে পারে লিবিয়ানরা। কারণ তাদের দু’জনকে বাংলাদেশীরা খুন করেছে। এতে তারা আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে আছে। তারপরও আমরা তাদের প্রতিরোধের মধ্যেই লাশ দাফন করে ফেলব। তবে কবে লাশ দাফন করা হবে সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। হবিগঞ্জের তোফাজ্জল তালুকদার নামের কোনো বাংলাদেশীর নাম নিহতের তালিকায় আছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ নামের বিষয়ে আরো একাধিক ফোন এসেছে। তবে এখনও বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে তার সাথে থাকা বন্ধু যশোরের আব্দুর রহমানের নাম নিহতের তালিকায় আছে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি মানবপাচার হয়েছে লিবিয়ায়। অনেকেই নৌকা যোগে ইউরোপের দেশ ইতালিতে গিয়ে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করছে- দালালদের এমন প্ররোচনায় পড়েই বাংলাদেশী যুবকরা ভিজিট ভিসায় লিবিয়ায় পাড়ি জমাতে শুরু করে। অভিযোগ আছে, লিবিয়ায় থাকা স্থানীয় বাংলাদেশী কমিউনিটির সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ এই চক্রের সাথে জড়িত। তাদের মদদেই ঢাকার পাচারকারী চক্র বেশি উৎসাহিত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকার ফকিরাপুল, মতিঝিল, পল্টনের বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে কোথায় কারা কিভাবে প্রতিনিয়ত বিমানবন্দরে কন্টাক্ট করে মানবপাচার করছে সেসব প্রশাসনের অজানা নয় বলে ভুক্তভোগী ও প্রশাসন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
Leave a Reply