দান-সাদকা একটি মহান ইবাদত। সাদকাদাতার ইহ ও পরকালীন সম্মান ও গৌরব বৃদ্ধি করে এবং বিপদাপদ দূর করে। হায়াত বৃদ্ধি করে। যেসব ইবাদতের অসংখ্য পুরস্কারের কথা কুরআন-হাদিসে উল্লেøখ রয়েছে- দান-সাদকা তার মধ্যে অন্যতম। শুধু বিপুল সওয়াব প্রাপ্তিই নয়, দানের উপকারিতা নানামুখী।
ইসলাম এমন একটি জীবন-দর্শন, যার অন্যতম সৌন্দর্য হলো দান, সাদকা, উদারতা ও মানবকল্যাণ। এটি প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব- যিনি তার জীবনের প্রতিটি প্রয়োজন পূরণে প্রতি ক্ষেত্রে ভারসাম্যমূলক নীতি অনুসরণ করবেন। তিনি তার সম্পদ শুধু নিজেই ব্যয় না করে তার সম্পদে অন্যদের যে অংশ আছে, সেটি প্রদানেও সচেষ্ট থাকবেন। আল্লাহর দেয়া নিয়ামত যেন সবাই মিলে উপভোগ করতে পারেন, তা তিনি নিশ্চিত করবেন। হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে আদম সন্তান! তোমরা তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করো। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর। একে আটকে রেখো না, আটকে রাখাটা তোমার জন্য অকল্যাণ হয়ে দাঁড়াবে। প্রথমে তোমার পরিবার ও তোমার ওপর নির্ভরশীলদের জন্য ব্যয় করো। আর তারপর তাদের জন্য হাতটা উঁচু করো, যাদের হাত তোমাদের তুলনায় নিচে।’ (মুসলিম-২২৭৮)
ইসলাম সবসময় তার অনুসারীদের আল্লাহর রাস্তায় এবং অভাবীদের জন্য সম্পদ ব্যয় করার নির্দেশ দেয়। মানুষ দুনিয়াতে দানশীল ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা করে এবং তার কল্যাণের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করে। আল্লাহ তায়ালা দানশীল ব্যক্তিকে ভালোবাসেন। তাই তিনি দানশীল ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন চূড়ান্ত সাফল্য দান করবেন। তার কাজের প্রতিদান হিসেবে তাকে জান্নাত দেবেন। আবু হুরায়রা রা: সূত্রে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘দানশীল মানুষ আল্লাহর অতিশয় কাছে থাকেন, মানুষেরও নিকটবর্তী ও জান্নাতেরও কাছে থাকেন। জাহান্নাম তার থেকে দূরে থাকে।’ (তিরমিজি-৬৯৪) কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তায়ালা দানশীলতার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন- ‘হে ঈমানদাররা! আমি তোমাদের যে জীবিকা দান করেছি, সে দিন আসার আগেই তোমরা তা থেকে ব্যয় করে নাও, যে দিন না থাকবে কোনো বেচাকেনা আর না কোনো সুপারিশ ও বন্ধুত্ব।’ (সূরা বাকারাহ-২৫৪)
দানের অপরিসীম সওয়াব ও ফজিলতের কথা শুনে আমরা অনেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনাথ, অসহায় ও বিপদগ্রস্ত লোকদের সহায়তা করি, তাদের প্রয়োজন পূরণে বিভিন্ন দান-সাদকা করি। আমাদের এসব দান ও অনুদান যদি হালাল ও বৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ থেকে হয়, তাহলে আল্লাহর কাছে তা গৃহীত হবে; নইলে এর কোনো প্রতিদান মিলবে না এবং কানাকড়িও মূল্যায়িত হবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে মুমিনরা! তোমরা তোমাদের বৈধ উপার্জন এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যে শস্য উৎপন্ন করি, তা থেকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করো। আর এরূপ মন্দ জিনিস দেয়ার নিয়ত করো না, যা তোমরা চোখ বন্ধ না করে তা গ্রহণ করবে না। মনে রেখো, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী; সর্বপ্রকার প্রশংসা তাঁরই।’ (সূরা বাকারাহ-২৬৭)
দানশীলতা মুসলিম উম্মাহর ভেতর সাম্য এবং একতার ভিত রচনা করে। দান-সাদকার মাধ্যমে ঈমানে পরিপূর্ণতা আসে। সম্পদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয়। দানশীলতা মানুষকে কৃপণতা থেকে বের করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চরিত্রের অধিকারী বানিয়ে দেয়। দান-সাদকা আত্মিক উৎকর্ষ সাধনে নিয়ামক শক্তি। এর মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভ হয়। সর্বোপরি দানশীলতা মানুষকে পাপমুক্ত করে জান্নাতের পথে পরিচালিত করে।
দান-সাদকা গোপনে ও প্রকাশ্যে দু’ভাবেই করা যায়। তবে গোপনে করা উত্তম। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-সাদকা করো, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি দান-সাদকা গোপনে করো এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরো উত্তম। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ তোমাদের কাজকর্মের খবর রাখেন।’ (সূরা বাকারাহ-২৭১)
আল্লাহ তায়ালা চমৎকার একটি উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের ধনসম্পদ খরচ করে, তাদের উদাহরণ একটি শস্যদানার মতো; যা থেকে সাতটি শীষ উৎপন্ন হয়। যার প্রতিটি শীষে এক শ’টি করে শস্যদানা থাকে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাকে অতিরিক্ত দান করেন। আল্লাহ মহাদানশীল ও মহাজ্ঞানী।’ (সূরা বাকারাহ-২৬১) পবিত্র কুরআনে আল্লাহ আরো বলেন- ‘আর যেসব উত্তম বস্তুসামগ্রী তোমরা ব্যয় করবে, তার লাভ ও সওয়াব তোমাদের কাছেই পৌঁছাবে। বস্তুত তোমাদের ব্যয় আল্লাহর ওয়াস্তেই হওয়া উচিত। আর যেসব উত্তম বস্তুসামগ্রী তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ব্যয় করবে, তোমরা তার পরিপূর্ণ বিনিময় প্রাপ্ত হবে; তোমাদের কোনো হকই বিনষ্ট করা হবে না।’ (সূরা বাকারাহ-২৭২)
উকবা ইবন আমের রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘নিশ্চয়ই দান-সাদকা দানকারীকে কবরের উত্তাপ থেকে রক্ষা করবে। আর মু’মিন ব্যক্তি কিয়ামত দিবসে আল্লাহর আরশের ছায়ায় অবস্থান করবে।’ (তাবারানি-৭৮৮, সুনানে বায়হাকি-৩৩৪৭) দান-সাদকার উপকার শুধু যে আখিরাতে পাওয়া যাবে তা কিন্তু নয়। দুনিয়াতেও এর প্রতিদান মিলবে। আনাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেছেন, ‘দান-সাদকা তো আল্লাহর ক্রোধের আগুন নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে।’ (তিরমিজি-৬৬৪)
সমাজের গরিব, দুস্থ, অভাবী ও অসহায় মানুষকে সহায়তা করার প্রতি ইসলাম অধিক গুরুত্বারোপ করে। সুযোগ হলে সাধ্যমতো তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করা, খাবার খাওয়ানো ও খোঁজখবর নেয়া উচিত। পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় মহান আল্লাহ তায়ালা গরিব, অসহায়, দিনমজুর ও মিসকিনদের খাবার দান করার কথা বলেছেন। আল্লাহ বলেন- ‘আমি তাকে দু’টি পথ প্রদর্শন করেছি। অতঃপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি জানেন, সে ঘাঁটি কী? তা হচ্ছে দাসমুক্ত করা কিংবা দুর্যোগ ও সঙ্কটের দিনে এতিম, আত্মীয়স্বজন ও ধুলো-ধূসরিত মিসকিনদের অন্ন দান করা।’ (সূরা বালাদ : ১০-১৬) অভুক্ত ব্যক্তিকে আহার্য দেয়ার ফজিলত বলতে গিয়ে রাসূল সা: বলেন, ‘মানুষের কল্যাণসংশ্লিষ্ট যত কাজ আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম হচ্ছে দারিদ্র্য ও ক্ষুধার্তকে খাবার দান করা।’ (বুখারি-১২)
আল্লাহই কিছু মানুষকে সম্পদ দিয়েছেন, আবার কিছু মানুষকে নিঃস্ব করেছেন। যাদেরকে সম্পদ দেয়া হয়েছে, তাদের সম্পদে অসহায় ও গরিব-মিসকিনদের হক রয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘ধনীদের ধনসম্পদে বঞ্চিত ও প্রার্থী মানুষের হক রয়েছে।’ (সূরা আজ-জারিয়াত-১৯)
লেখক :
সম্পাদক, মাসিক সারস, পূর্ব রূপসা, খুলনা
Leave a Reply