বহুমুখী সঙ্কটে অসহায় হয়ে পড়েছেন দেশের তৈরী পোশাক শিল্প মালিকরা। গ্যাসের মূল্য বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু গ্যাস নিয়মিত না পাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে অনেক শিল্পকারখানা। বিদেশী ক্রেতাদের সময় মতো পণ্য দিতে পারছেন না অনেক রফতানিকারক। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের পোশাকখাতের অর্ডার অন্য দেশে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন গার্মেন্টস শিল্প উদ্যোক্তারা।
দেশের গার্মেন্টস শিল্পের বেশির ভাগ কারখানা নারায়ণগঞ্জ জেলায়।
নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্টস মালিকরা জানান, বিভিন্ন সঙ্কটে পড়েছেন তারা। এসব সঙ্কটের প্রভাব পড়বে শ্রমিকদের ওপর। নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস না পাওয়া গেলে নতুন শিল্প উদ্যোক্তারা যেমন মুখ ফিরিয়ে নেবে, তেমনি কারখানা বন্ধ হলে লাখ লাখ শ্রমিক চাকরি হারাবে।
তৈরী পোশাক শিল্প মালিকদের বৃহৎ সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান জানান, ‘আমরা এখন অসহায়। নিরীহ মানুষের থেকেও আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা যারা গার্মেন্টস ব্যবসার কারণে ডলার নিয়ে ব্যবসা করি, আমাদের মতো অসহায় অবস্থা অন্য কোনো ব্যবসায় দেখা যায়নি।’
সেলিম ওসমান আরো বলেন, ‘ব্যাংক আমাদের ডলারের লিমিট দিয়েছে। হঠাৎ সকালে শুনলাম, ডলারের লিমিট ৩০ পার্সেন্ট কমিয়ে দিয়েছে। এটা কেমন কথা? আমরা এলসি খুলছি, আমাদের যারা সাপ্লাই করছে তাদেরকে ডলার দেয়া যাচ্ছে না। কারণ ব্যাংকের কাছে ডলার রিজার্ভ নাই। আমাদেরকে মালামাল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘’গ্যাস আমাদের শেষ হয়ে গেছে। সরকার আমাদের বলে, ‘তোমরা যদি ইমপোর্টের পয়সা দাও, আমরা তোমাদের গ্যাস দিব।’ আমরা দীর্ঘ মিটিং করলাম। রাজি হয়ে গেলাম গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে দেন। ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করে দেয়া হলো। আমাদের মানুষগুলোকে বাঁচতে হবে। আমরা বাঁচব কি-না তা কথা ছিল না, শ্রমিক ভাইয়ের বাঁচার কথা চিন্তা করি। ৬৫ ভাগ নারী শ্রমিক আমাদের কাজের ওপর নির্ভর করছে।’’
কোনো লাভের মুখ দেখেন না উল্লেখ করে সেলিম ওসমান বলেন, ‘অনেকে মনে করে যে আমরা যারা ব্যবসা করি, আমরা যারা এক্সপোর্ট করি- আমরা খুব ভালো আছি। বিশ্বাস করেন, আমাদের মতো অবস্থা কারো নেই। আমরা অসহায় এখন। আমরা লাভের মুখ দেখি না। আমরা লস করতে করতে এমন জায়গায় এসে ঠেকেছি যে আমার কাছে মনে হয় আমার দাদা যে ব্যবসা (পাটের ব্যবসা) করতেন আমরা ওই ব্যবসা করছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভয়াবহ গ্যাস সঙ্কটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, ফতুল্লার কাঠেরপোল, বিসিক শিল্পনগরীসহ জেলার বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে। গ্যাস সঙ্কটে রফতানিমুখী তৈরী পোশাক শিল্পের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
গত চার মাসে গ্যাস সঙ্কটে বন্ধ হয়েছে ৪০টির বেশি শিল্পকারখানা। যারা কারখানা চালু রেখেছে, তাদেরও চালাতে হচ্ছে ধুঁকে ধুঁকে। কাপড় ডাইং করতে গেলে গ্যাস মিলছে না। গ্যাস সঙ্কটে উৎপাদন বন্ধ থাকায় অলস সময় পার করছে শ্রমিকরা।
ফতুল্লার কাঠেরপোল এলাকায় অবস্থিত আজাদ রিফাত ফাইবার্স প্রাইভেট লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম রাজীব বলেন, ‘গ্যাস সঙ্কটের এমন দুরবস্থায় গ্যাস বিল দেয়া হচ্ছে, কিন্তু গ্যাস লাইনে পাওয়া যাচ্ছে বাতাস। গ্যাস সঙ্কটে সময় মতো বিদেশী ক্রেতাদের অর্ডার করা পণ্য না দিতে পারায় অনেক অর্ডার বন্ধের পথে। আবার গ্যাসের বিলও অনেক বাড়ানো হয়েছে।’
ফতুল্লা পঞ্চবটির বিসিক শিল্পনগরীর ক্রোনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এইচ এম আসলাম সানী বলেন, ‘আড়াই বছর ধরে গ্যাস সঙ্কটে ভুগছি। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের পরে অর্থনৈতিক যে মন্দা, ওই মন্দায় প্রত্যেক বায়ার ৩০ ভাগ আরএমজি কম দিচ্ছে, ডিমান্ড কমে গেছে মার্কেটে। ডিমান্ড কমে যাওয়ায় আমরা কিছু কিছু অর্ডার পাচ্ছি। আবার টিকে থাকার জন্য অর্ডারগুলো এক্সিকিউট করতে পারছি না গ্যাস সঙ্কটের কারণে। গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর পর ব্যবসায়ীদের নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস দেয়া হবে বলে সরকার জানিয়েছিল, কিন্তু তা বিভিন্ন কারণে ব্যাহত হচ্ছে।’
নারায়ণগঞ্জের ফেয়ার অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ কাশেম বলেন, ‘আমরা বিদেশী ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়েছি। কিন্তু গ্যাস সঙ্কটে ডায়িং করতে পারছি না। গ্যাসের প্রেসার নেই। যখন থাকে তখন এত কম থাকে যে আমরা জেনারেটর চালাতে পারি না। এক দিনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি সময়ই জেনারেটর বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাস না থাকায়। বয়লার বন্ধ। কাপড় ডাইং মেশিনে উঠানো হলেও কন্টিনিউ প্রসেস না হলে গ্যাস ফল্ট করলে তখন ফেব্রিক্সে সমস্যা হয়। আবার দ্বিতীয়বার ডাইং করতে দ্বিগুণ সময় লাগে, বেড়ে যায় উৎপাদন খরচও।’
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) জানান, বাংলাদেশের পোশাক রফতানির অর্ডার সারাবিশ্বে কমে গেছে। সময় মতো শিপমেন্ট করতে না পারলে বিদেশী ক্রেতারা অর্ডার ক্যানসেল করে দেয়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশেনের (বিটিএমএ) পরিচালক ও ফতুল্লার হাশেম স্পিনিং মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম সোলায়মান বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কটে দেশের বেশিরভাগ স্পিনিং মিলের উৎপাদন ৩০ ভাগ কমে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অনেক স্পিনিং মিল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড ট্রান্সমিউশন কোম্পানি লিমিটেড নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয় বলছে, ‘নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট। সেখানে আমরা পাচ্ছি ৭০ থেকে ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না থাকায় গ্যাসের সঙ্কট রয়েছে।’
Leave a Reply