এমন অনুভূতি কতই না সুন্দর- বান্দা জমিনে মাথা নুইয়ে ফিসফিস করে কিছু বলছেন আর আসমানের মালিক তা কান পেতে শুনছেন, সুবহান আল্লাহ।
এই অনুভূতিটি পেতে হলে আপনাকে অবশ্যই সালাতে দাঁড়াতে হবে, আপনি যখন সিজদায় অবনত মস্তকে তাসবিহ পাঠ করবেন তখন আসমান থেকে আপনার রব সেই তাসবিহ কান পেতে শুনবেন। বান্দা হিসেবে দুনিয়ায় এর চেয়ে মধুর অনুভূতি আর কিছুতে আপনি পাবেন না। আর সালাতে এই অনুভূতি তখনই আসবে যখন আপনি পূর্ণ মনোযোগী হয়ে অর্থাৎ খুশু ও খুজুুর সাথে সালাত আদায় করবেন।
কুরআন-হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, সালাতের প্রাণ হচ্ছে ‘খুশু-খুজু’ বা বিনয় ও নম্রতা। সালাতের যাবতীয় ফজিলত, প্রভাব ও উপকারিতা এই খুশু-খুজুর সাথেই সম্পৃক্ত। যদি নামাজি খুশু-খুজুুর সাথে সলাত আদায় না করে, তাহলে তার সালাত পার্থিব দায়িত্বমুক্তি ব্যতীত ইহকাল ও পরকালে আর কোনো ফায়দা বয়ে আনতে পারবে বলে কোনো গ্যারান্টি নেই।
খুশু-খুজুু কি :খুশু আরবি শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ- বিনয় ও নম্রতা। পরিভাষায় ‘খুশু’ শব্দটির দু’টি অর্থ রয়েছে। ১. বিনয় ও নম্রতা; ২. শান্তি ও স্থিরতা। অন্তরে খুশু বলতে এই উভয় অর্থকেই বোঝায়। সালাতের মধ্যে খুশু থেকে উদ্দেশ্য অন্তরের ওই অবস্থাদ্বয়, যা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতি প্রসারিত হয় এবং তাতে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়েও শান্ত ও বিনয়ীভাব প্রকাশ পায়। সালাতে আল্লাহর ভালোবাসা, ভয়-ভীতি ও সাওয়াবের প্রত্যাশায় এর আদ্যোপান্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ডে খুশুর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। খুশু হচ্ছে সালাতের প্রাণ ও সালাতের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য। খুশুবিহীন সালাতের দৃষ্টান্ত মৃত লাশের মতো, যার কোনো প্রাণ নেই। সত্যিকারার্থে যারা খুশু-খুজুুর সাথে সালাত আদায় করে, কুরআন-সুন্নাহতে তাদের ব্যাপারে যথেষ্ট ফজিলত বর্ণিত রয়েছে।
‘খুশু’ এর প্রায় সমার্থবোধক শব্দ হচ্ছে খুজু। তবে উভয় শব্দের মধ্যে সামান্য পার্থক্য বিদ্যমান। তা হচ্ছে, খুশু মূলত কণ্ঠ ও দৃষ্টির নিম্নমুখিতা এবং তা এরূপ বিনয় প্রকাশার্থে ব্যবহার হরা হয়, যা কৃত্রিম নয়; বরং অন্তরের ভীতি ও নম্রতার ফলশ্রুতি স্বরূপ হবে। আর ‘খুজুু’ শব্দটি দৈহিক ও বাহ্যিক বিনয় এবং নম্রতাকে বোঝায়।
মহান আল্লাহ ইরশাদ করছেন- ‘এবং আল্লাহর জন্য দাঁড়াও বিনীত হয়ে।’ (সূরা আল-বাকারা-২৩৮) এখানে আল্লাহর জন্য দাঁড়ানো বলতে সালাতে দাঁড়াতে বলা হয়েছে, বিনীত হওয়া বলতে একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতার সাথে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করতে বলা হয়েছে। কেননা সালাত মানেই আল্লাহর সাথে কথা বলা আর আমরা যার সাথে কথা বলি নিশ্চয়ই তার দিকে পূর্ণ মনোযোগী হয়েই কথা বলি, যদি এমন হয় যে যার সাথে কথা বলছি তাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছি না তাহলে নিশ্চয়ই তিনিও আমাদের গুরুত্ব দেবেন না এটিই স্বাভাবিক।
খুশুর ফজিলত : কুরআন কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে। যারা নিজেদের নামাজে বিনয় নম্র।’ (সূরা মুমিনুন : ১-২) হাফেজ ইবনে কাছির রহ: দ্বিতীয় আয়াতের তাফসিরে লিখেন, যারা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে এবং স্থিরতার সাথে নামাজ আদায় করে, তারাই এ আয়াতের উদ্দেশ্য। আর ‘খুশু’ অর্থ শান্তময়িতা, স্থিরতা ও নম্রতা। যা আল্লাহর ভয় ও তাঁর মুরাকাবার কারণে অন্তর ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে প্রকাশ পায়, এর নামই হচ্ছে খুশু। (তাফসিরে ইবনে কাছির, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩১৭)
অন্য আয়াতে আছে- ‘আর আল্লাহর সামনে একান্ত আদবের সাথে দাঁড়াও।’ (সূরা বাকারা-২৩৮) এ আয়াতে ‘কুনুত’ অর্থ- আল্লাহর ভয়ে নত ও নম্র হওয়া, চক্ষু নিচু করা এবং দুই বাহুকে ঝুঁকিয়ে দেয়া।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ‘ধীরস্থির ও নম্রতার সাথে মধ্যম পন্থায় দুই রাকাত নামাজ আদায় করা, উদাসীনভাবে গোটা রাত জাগ্রত থাকার চেয়েও উত্তম।’ (শরহুস সুন্নাহ, বাবুল খুশু ফিস সালাত)
খুশুর স্থান অন্তর : খুশু তথা একাগ্রতার স্থান অন্তর তবে এর প্রভাব বিকশিত হয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। ওয়াসওয়াসা কিংবা অন্য মনস্কের দরুন খুশুতে বিঘœতার ফলে অঙ্গ-প্রতঙ্গের ইবাদতেও বিঘœতার সৃষ্টি হয়। কারণ, অন্তকরণ বাদশাহ আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আজ্ঞাবহ-অনুগত সৈনিকের মতো। বাদশাহর পদস্খলনে সৈনিকদের পদস্খলন অনস্বীকার্য। তবে কপট ও বাহ্যিকভাবে খুশু তথা একাগ্রতার ভঙ্গিমা নিন্দনীয়; বরং ইখলাসের নিদর্শন হলো- একাগ্রতা প্রকাশ না করা।
হুজায়ফা রা: বলতেন, ‘নেফাকসর্বস্ব খুশু থেকে বিরত থাকো। জিজ্ঞাসা করা হলো, নেফাকসর্বস্ব খুশু আবার কি? উত্তরে বললেন, শরীর দেখতে একাগ্রতাসম্পন্ন অথচ অন্তর একাগ্রতা শূন্য।’
ফুজায়েল বলেন, ‘আগে অন্তরের চেয়ে বেশি খুশু প্রদর্শন করা ঘৃণার চোখে দেখা হতো।’ জনৈক বুজুর্গ এক ব্যক্তির শরীর ও কাঁধে খুশুর আলামত দেখে বললেন, এই ছেলে! খুশু এখানে, বুকের দিকে ইশারা করে। এখানে নয়, কাঁধের দিকে ইশারা করে। (মাদারিজ-১/৫২১)
সালাতের ভেতর খুশু একমাত্র তারই অর্জিত হবে, যে সব কিছু ত্যাগ করে নিজেকে সালাতের জন্য ফারেগ করে নেবে এবং সব কিছুর ঊর্ধ্বে সালাতকে স্থান দেবে। তখনই সালাতের দ্বারা চোখ জুড়াবে, অন্তর ঠাণ্ডা হবে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সালাতেই আমার চোখের শান্তি রাখা হয়েছে।’ (মুসনাদে আহমাদ-৩/১২৮)
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে মনোনীত বান্দাদের আলোচনায় খুশুর সাথে সালাত আদায়কারী নারী-পুরুষের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাদের জন্য ধার্যকৃত ক্ষমা ও সুমহান প্রতিদানের ঘোষণা দিয়েছেন। (সূরা আল-আহজাব-৩৫) খুশু বান্দার ওপর সালাতের দায়িত্বটি স্বাভাবিক ও হালকা করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় তা খুশুওয়ালা-বিনয়ী ছাড়া অন্যদের ওপর কঠিন।’ (সূরা আল-বাকারা-৪৫) অর্থাৎ সালাতের কষ্ট বড় কঠিন, তবে খুশুওলাদের জন্য কোনো কষ্টই নয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির-১/১২৫) খুশু যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন কঠিন ও দুর্লভ, বিশেষ করে আমাদের এ শেষ জামানায়। আল্লাহর রাসূল সা: বলেন, ‘এই উম্মত হতে সর্ব প্রথম সালাতের খুশু উঠিয়ে নেয়া হবে, এমনকি তালাশ করেও তুমি কোনো খুশুওয়ালা লোক খুঁজে পাবে না।’ (তাবারানি) (আগামী দিন সমাপ্য)
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
Leave a Reply