দেশে নিত্যপণ্যসহ সব ধরনের দ্রব্যের দাম বেড়েছে। বাজারের ঊর্ধ্বগতিতে চাপ বাড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর। সরকারি সংস্থা পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যই বলছে, এপ্রিলে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে জিনিসপত্রের দামে কোনো স্বস্তি নেই। আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছি। ফলে সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এতে অনেককে খাদ্যতালিকায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এমন এক সময়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছেন। এটি হবে এই সরকারের শেষ বাজেট। সে অর্থে এটি নির্বাচনী বাজেটও। সেই বাজেটে অর্থমন্ত্রী নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কী বার্তা দেবেন, সেদিকে তাকিয়ে আছেন দেশের মানুষ।
জানা গেছে, জনসাধারণকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে চায় সরকার। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের বাকি কিস্তিগুলো পেতে সরকারকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়াতে হচ্ছে দফায় দফায়। বাজেট ঘোষণার পরপরই হয়তো বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতে পারে আবারও। এমনিতেই মূল্যস্ফীতি দুই অংক ছুঁইছুঁই করছে। অন্যদিকে প্রায় দেড় বছর ধরে চলমান ডলার সংকট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘই হচ্ছে। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধও দীর্ঘ হচ্ছে। যদিও শুরুতে এই সংকট এতটা লম্বা হওয়ার তো কোনো ইঙ্গিত ছিল না। এত সব সংকটের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী চলতি বছরের শেষ বা আগামী বছরের শুরুতে বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সে হিসাবে আসছে বাজেটের প্রথম ছয় মাস বাস্তবায়ন করতে পারবে এই সরকার। পরবর্তী ছয় মাস বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী নতুন সরকার। এবারের বাজেট হবে দেশের ৫২তম এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৪তম বাজেট।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী খাতে বরাদ্দ হতে পারে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। সরকারের ১৪১টি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি রয়েছে। আগামী অর্থবছরের পরিকল্পনা হচ্ছে বয়স্ক মানুষ, বিধবা ও নিঃস্ব নারীদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো। এই সুবিধার আওতায় ভাতাপ্রাপ্তদের সংখ্যাও বাড়ানো হবে। খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী, বয়স্কদের জন্য ভাতা ৫শ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬শ টাকা করা হবে এবং প্রায় ৫৮ লাখ সুবিধাভোগী থাকবে, যা বর্তমান সংখ্যার চেয়ে প্রায় ১ লাখ বেশি। এতে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে ৭৬১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। ফলে মোট বরাদ্দ ৪ হাজার ৩০৫ কোটি টাকায় দাঁড়াবে।
জানা গেছে, বিধবা ও নিঃস্ব নারীদের জন্য ভাতা ৫শ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৫০ টাকায় উন্নীত করা হবে এবং সুবিধাভোগীদের তালিকায় আরও ১ লাখ নাম যুক্ত হবে। ফলে মোট সুবিধাভোগীর সংখ্যা গিয়ে ২৫ লাখ ৭৫ হাজারে দাঁড়াবে। এর জন্য অতিরিক্ত ব্যয় হবে ২১৬ কোটি টাকা। ফলে মোট বরাদ্দ ১ হাজার ৭১১ কোটি ৪০ লাখ টাকায় দাঁড়াবে। তবে দরিদ্র প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা আগের মতো ৮৫০ টাকাই থাকবে। এই তালিকায় আরও ৫০ হাজার মানুষের নাম যুক্ত হবে। ফলে মোট সুবিধাভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ২৪ লাখ ১৫ হাজারে। বর্তমানে প্রায় ১ লাখ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাচ্ছে এবং এই সংখ্যাও বাড়বে। ওএমএস (খোলাবাজারে বিক্রয়), ভিজিডি (ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং) ও অন্যান্য কর্মসূচি, যা দরিদ্রদের খাদ্য কিনতে সহায়তা করে, সেগুলোর জন্য বরাদ্দ বর্তমান ১৯ হাজার কোটি টাকাই থাকবে।
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো বলছে, আগামী বাজেটের মোট আকার হতে পারে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা হতে পারে। বাজেটের মোট আয় ধরা হতে পারে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয় ধরা হতে পারে ৪ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার। ফলে আগামী অর্থবছরে ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা এবং সুদ পরিশোধে ব্যয় ১ লাখ ২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে বাজেটের খসড়ায়।
জানা গেছে, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় ইতোমধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা করপোরেশনের জন্য ১১ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকার এডিপিও অনুমোদিত হয়েছে। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও দেশের সম্পদ, বৈদেশিক অর্থায়ন ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আসছে ২০২৩-২৪ বাজেটে মোটা দাগে কতগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে তা হলো- মূল্যস্ফীতি, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। দেশে গত কয়েক বছরের বেকারের সংখ্যা বেড়েছে অনেক বেশি। ভর্তুকির নিরাপদ সংস্থান করতে হবে। বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনতে হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একইভাবে বৈদেশিক মুদ্রার সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে স্থিতিশীল শক্তিশালী রিজার্ভ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে হলে সরকারকে এ খাতে অবশ্যই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো বলছে, কর-কাঠামোতে এমন কিছু কৌশলগত পরিবর্তন আনা হবে, যাতে করে ভোগ্যপণ্যের বাজারে এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। আবার সরকারের রাজস্ব আদায়ও বাড়ে। এতে করে চাল, ডাল, তেলসহ খাদ্যপ্যণের দাম কমানোর কার্যকর উদ্যোগের নির্দেশনা দেওয়া হবে। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আসছে বাজেটে নির্বাচনী কৌশল, ব্যবসা-বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। সে অনুযায়ীই বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজেটের অন্যতম সমস্যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব আদায় কম। এই আয় বাড়ানোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে কর ফাঁকি রোধ এবং নতুন করদাতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে এবার বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
Leave a Reply