বাংলাদেশে এক হাজার টাকার নোটের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। এটা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ কাগুজে নোট। ভারতে দুই হাজার রুপির নোট বাতিল করা হয়েছে। বড় নোট নিয়ে কথা হচ্ছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের চিন্তা কী?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বেশি টাকার নোটের সুবিধা ও অসুবিধা দু’দিকই আছে। এটা অনেকটা মূল্যস্ফীতির ওপর নির্ভর করে। তাই অনেকে দেশে ১০ হাজার মুদ্রার নোটও আছে। বাংলাদেশে এখন মূল্যস্ফীতি যে পর্যায়ে রয়েছে তাতে এক হাজার টাকার নোট স্বাভাবিক। তবে সমস্যা হচ্ছে বড় নোট থাকায় তা চোরাচালান, অর্থ পাচার, ঘুস লেনদেনসহ বিভিন্ন অবৈধকাজে এ নোটের ব্যবহার বেড়ে যায়। আর এই বড় নোট জালও হয় বেশি।
বাংলাদেশে ব্যাংক নোট বলতে ১০, ২০, ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০ ও এক হাজার টাকা চালু রয়েছে। আর এক, দুই ও পাঁচ টাকার নোট ও কয়েন হলো সরকারের।
বাংলাদেশে এক হাজার টাকার নোট চালু হয় ২০০৮ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাজারে প্রচলিত নোটের মধ্যে এক হাজার টাকার নোটের পরিমাণ দ্রুত গতিতে বাড়ছে।
২০১১ সালেও দেশে মোট ব্যাংক নোটের ২৪.৫৪ ভাগ ছিল হাজার টাকার নোট। এখন তা অর্ধেকেরও বেশি। বাজারে থাকা নগদ অর্থের এক লাখ ৩৪ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা আছে এক হাজার টাকার নোটে। এটা দেশের মোট ইস্যু করা নোটের ৫২.৭৭ ভাগ। আরো ৩৮.৮০ ভাগ ৫০০ টাকার নোট। এ হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট ইস্যুকৃত অর্থের ৯১ ভাগের বেশি উচ্চমূল্যের নোট।
২০২১-২২ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক হাজার টাকার নোট ছাপিয়েছে ১৯ কোটি ৩৯ লাখেরও বেশি। বাজারে এক হাজার টাকার নোটের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬.৮৭ ভাগ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো একটি অর্থনীতির দেশে ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার নগদ অর্থ যথেষ্ট। ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ১০ থেকে ১২ ভাগ নগদ হিসেবে বাজারে থাকাই যুক্তিযুক্ত মনে করেন তারা। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের প্রায় ১৮ ভাগ বাজারে নগদ অর্থ হিসেবে আছে।
যমুনা ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো: নুরুল আমিন বলেন, ‘বড় নোটের প্রথম সমস্যা হলো বড় নোট দিয়ে অবৈধ লেনদেন সুবিধা, পাচার করা সুবিধা, ঘুস লেনদেনের সুবিধা, টাকা ব্যাংকের বাইরে জমিয়ে রাখার সুবিধা। মোট কথা, যারা অনৈতিক কাজ করেন তাদের জন্য বড় নোট আকর্ষণীয়। এর কারণেই হয়ত প্রয়োজনের তুলনায় বেশি নগদ অর্থ ব্যাংকের বাইরে আছে। আর তা হাজার টাকার নোটই বেশি।’
তিনি জানান, বড় নোটের আরেকটা সমস্যা হচ্ছে জাল টাকা। যারা টাকা জাল করে তারা তাদের সুবিধার জন্য বড় নোটই জাল করে। এ কারণে হাজার টাকার নোট দিয়ে লেনদেনের সময় সতর্কতা জরুরি। অনেকে প্রতারিত হয়।
তবে এর বিপরীত দিকও আছে বলে জানান তিনি।
তার মতে, ‘নোট কতটা বড় হবে তা নির্ভর করে মূল্যস্ফীতির ওপর। এখন পাকিস্তান, জিম্বাবুয়েকে অনেক বড় নোট আছে। কোথাও ১০ হাজার টাকার নোটও আছে। বড় নোট বহন করাও সহজ।’
তার কথায়, ’ভারতে মোদি সরকার প্রথমবার ১০০ রুপির নোটও ব্যান্ড করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কালো টাকা দূর করা। এবারো হয়ত কালো টাকা, অবৈধ লেনদেন বন্ধ করতে এটা করেছে। কিন্তু ছোট নোট ব্যান্ড করলে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ে। আর বড় নোট ব্যান্ড করলে পুরোটা ব্যাংকে আসে না। কারণ অনেকে কালো টাকা প্রদর্শন করে বিপদে পড়তে চায় না।’
বাংলাদেশ ব্যাংক যে দুই হাজার টাকার নোট চালুর চিন্তা করছে তা এখন করা ঠিক হবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন বাজারের যা অবস্থা তাতে এক হাজার টাকার নোট চলতে পারে, কিন্তু এর চেয়ে বড় নয়। এখন এক হাজার ও ৫০০ টাকার নোট বেশি। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে এক হাজার নোট ছেপে বাজারে দিচ্ছে। এর সমস্যাও আছে। তার সমাধান হতে পারে ক্যাশলেস ট্রান্সজেকশন। কিন্তু দেশের সব মানুষ বিশেষ করে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষ তো তা পারবে না। তাই কাগুজে নোট তো পুরোপুরি বিদায় করা যাচ্ছে না।’
তিনিও মনে করেন, ‘বড় নোট অবৈধ লেনদেন, টাকা পাচারসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজে ব্যবহার হয় বেশি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেসবাউল হক বলেন, ‘এক হাজার টাকার নোট জাল হয় বেশি। তা দেখার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে। তারা দেখছে। আর অন্য যেসব কথা আছে বড় নোট নিয়ে তা দেখার জন্যও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ আছে। এক হাজার টাকার নোট নিয়ে ভারতের মতো কোনো চিন্তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুই হাজার টাকার নোট ইস্যু নিয়েও কোনো চিন্তা বা সিদ্ধান্ত নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের।’
বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পরসহ মোট দু’বার ১০০ টাকার নোট ব্যান্ড করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল চোরাচালান ও অবৈধ লেনদেন বন্ধ করা বলে জানান বিশ্লেষকরা।
সূত্র : ডয়চে ভেলে
Leave a Reply