পাবনা জেলার রূপপুরে রাশিয়ার ঋণে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে তার ঋণের কিস্তি ফেরত দেয়া নিয়ে আবারো জটিলতা তৈরি হয়েছে।
সপ্তাহদুয়েক আগে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সমঝোতা হয় যে ঋণের প্রথম কিস্তির প্রায় ৩২ কোটি ডলার সমমানের অর্থ পরিশোধ করা হবে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে। কিন্তু রূপপুরে যে সংস্থা বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করছে, তাদের ওপর নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় আবারো ঋণ শোধের উপায় নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা গেছে।
এর আগে আর্থিক লেনদেনের আন্তর্জাতিক চ্যানেল সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংক প্রত্যাহার, রুশ ব্যাংকের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, রাশিয়ার জাহাজ বাংলাদেশের বন্দরে সময়মত আসতে না দেয়ার মতো বেশকিছু কারণে ঋণ পরিশোধ প্রক্রিয়া বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
যে রুশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি রূপপুরের প্রকল্পের কাজ করছে, সেটি রাশিয়ার পারমাণবিক শক্তি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ‘রোসাটম’-এর একটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান। আর এই রোসাটম আমেরিকার সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি।
বাংলাদেশ যে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় থাকা একটি রুশ প্রতিষ্ঠানের সাথে আর্থিক লেনদেন করছে, এ বিষয়টি ঢাকার মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে বলে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
সেসব খবরে বলা হচ্ছে যে গত সপ্তাহে এই বিষয়টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কেও জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রূপপুর প্রকল্পের সার্বিক দায়িত্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ওপর।
এরকম পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে রূপপুরের ঋণ কিভাবে শোধ করা হবে, সেটি নিয়ে। আর আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে একের পর এক সমস্যার কারণে সময়মত এই প্রকল্প শেষ হবে কি না, তা নিয়েও স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়েছে সংশয়।
যদিও রোসাটম এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, ‘রোসাটমের ভেতরে একক কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পে প্রভাব ফেলবে না।’
আমেরিকার ট্রেজারি বিভাগ ১২ এপ্রিল রাশিয়ার ২৫ জন ব্যক্তি ও ২৯টি প্রতিষ্ঠানের ওপর নতুন এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
এসব নিষেধাজ্ঞা মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে রাশিয়ার শক্তি খর্ব করার উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে।
আমেরিকা বলছে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা রাশিয়ান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো যেন ‘যুদ্ধক্ষেত্রে পুতিনকে সহায়তা’ করতে না পারে, সে লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
ট্রেজারি ফর টেররিজম অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি ব্রায়ান ই নেলসন ১২ এপ্রিল এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার সময় বলেন, ‘যেকোনো তৃতীয় পক্ষ রাশিয়ার যুদ্ধের সমর্থন করলে তাদের চড়া মূল্য দিতে হবে বলে জি সেভেনে আমাদের যে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ছিল, তা আজকের সিদ্ধান্তে প্রমাণিত হয়েছে।’
নিষেধাজ্ঞায় থাকার ফলে এর আওতাধীন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সব সম্পদ, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে বা আমেরিকান নাগরিকের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেগুলো আটকে দেওয়া হয়। অর্থাৎ তারা আপাতত এগুলো ব্যবহার করতে পারবেন না।
এছাড়া আমেরিকার ভেতরে কোনো প্রতিষ্ঠান ও কোনো আমেরিকার নাগরিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কোনোপ্রকার আর্থিক লেনদেন করতে পারবেন না।
কিন্তু আমেরিকার নাগরিক বা আমেরিকান মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা বাংলাদেশের কেন মেনে চলতে হবে?
সাবেক কূটনীতিক মুন্সী ফয়েজ আহমেদ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এসব নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের মেনে চলতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই।
তিন বলেন, ‘বাংলাদেশ আমেরিকার এসব নিষেধাজ্ঞা মানতে বাধ্য নয়। কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু ছোট দেশ, কম শক্তিশালী দেশ, তারা তাই এসব মেনে চলে।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা না মেনে ভারত রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য করছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো করেছে, তাদের ক্ষেত্রে তো কিছু হয়নি।’
তার মতে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা না মেনে পরীক্ষামূলকভাবে দেখতে পারে যে এর ফল কী হয়।
তিনি জানান, ‘এসব নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে লাভবান হচ্ছে তা নয়। তাই তাদের পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে যে কতদূর পর্যন্ত তারা যায়।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি যেটা করতে পারে, তা হলো বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া। আমেরিকায় আমাদের রফতানির বাজার সংকুচিত করতে পারে। সেক্ষেত্রে আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে আমার মনে হয় না সেদিকে তারা যাবে।’
২০২২ সালে ইউক্রেনে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর থেকে আমেরিকা ও ইউরোপ রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন রকম নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার অর্থনৈতিক লেনদেনের রাস্তা সংকীর্ণ করে দেয়া।
বাংলাদেশের সাথে রাশিয়ার লেনদেনও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রকমের নিষেধাজ্ঞার জন্য বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
সুইফট থেকে রাশিয়ার কিছু ব্যাংককে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া, রূপপুরে ঋণ সহায়তা দেয়া রাশিয়ান ব্যাংককে নিষিদ্ধ করা, প্রকল্পের যন্ত্রপাতি বহন করা জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার মতো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় আমেরিকা।
এসবের ধারাবাহিকতায় বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে চীনা ইউয়ানে ঋণ শোধের বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসে রাশিয়া ও বাংলাদেশ, যা নিয়ে এখন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
তবে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন ইউয়ানে ঋণ শোধ করা হলে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
‘রাশিয়াকে ইউয়ানে ঋণ শোধ দিতে হলে সেই ইউয়ান তো বাংলাদেশের ডলার দিয়েই কিনতে হবে, কারণ বাংলাদেশের তো সেই পরিমাণ ইউয়ান নেই। সেক্ষেত্রে আর্থিকভাবে বাংলাদেশের কিছুটা ক্ষতিই হবে বলে আমি মনে করি’, বলছিলেন বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান।
মূলত আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার কারণেই কিছুটা ক্ষতি হলেও দুই দেশ ইউয়ানে লেনদেনে রাজি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তবে তার মতে, বাংলাদেশ ও রাশিয়া নিজেদের মধ্যে ডলারে লেনদেন না করলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নানাভাবে চাপের ওপর রাখতে চাইবে।
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সুইফট ছাড়াও ডলারে লেনদেনের বিকল্প পদ্ধতিতে বাংলাদেশ হয়তো রাশিয়াকে ঋণের অর্থ শোধ দিতে পারবে। কিন্তু অন্য কোনো মুদ্রা ব্যবহার করলে আরো অনেক রকম নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়বে বলে আমি মনে করি।’
তবে দীর্ঘমেয়াদে রাশিয়ার ঋণ শোধ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে আমেরিকা জটিলতা তৈরি করবে না বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
সুইফটের বিকল্প যে আর্থিক লেনদেন চ্যানেল রাশিয়া প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, সেই চ্যানেলেই বাংলাদেশকে ঋণ শোধ করতে হতে পারে বলে ধারণা করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘দুই দেশের ঋণ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে লেনদেনে হয়তো আমেরিকা খুব একটা বাধা দেবে না। কারণ দুটি দেশের মধ্যে যদি এই দ্বিপক্ষীয় লেনদেন করতে না দেয়া হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।’
রূপপুর প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে এক হাজার ১৩৮ কোটি ডলার ঋণ নেয় বাংলাদেশ, যার কিস্তি শোধ শুরু হওয়ার কথা ২০২৭ সালে।
তবে এর আগে ২০১৩ সালে দুই হাজার চার শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য যে ঋণ চুক্তি করা হয়েছিল রাশিয়ার সাথে, সেটির সুদ বাংলাদেশ পরিশোধ করা শুরু করেছে ২০১৮ সাল থেকে।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply