রমজান এলে মুসলমানদের হৃদয়ে জাগে পবিত্র শিহরণ। চার দিকে সৃষ্টি হয় স্বর্গীয় আবহ। পবিত্র রমজানে একজন রোজাদার শুধু পানাহার বর্জনেই সন্তুষ্ট থাকেন না; বরং সবরকম কটু কথা, মন্দ কাজ ও যাবতীয় অনাচার থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি সারা বছরের জন্য এক সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন এবং রোজার সেই অনুপম শিক্ষা পুরো বছরে তার জীবনমানে প্রতিভাত করতে উদ্যমী হন। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিবাদ-বিশৃঙ্খলা ও সবধরনের ঝগড়া-ফাসাদ থেকেও নিজেদের দূরে রাখার প্রয়াস চালান। কেউ শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে এলে রোজাদার বলে ওঠেন, ‘আমি কোনোমতেই তোমার সাথে বিবাদে যাবো না। কেননা, আমি আল্লাহর নামে রোজা রেখেছি।’ রোজাদারের চিন্তাচেতনা, মন-মানসে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন; ক্ষুধা-তৃষ্ণার যাতনায় নিজেকে জর্জরিত করে সে অভুক্ত মানুষের কষ্ট বা আহাজারি অনুভবের এক সুবর্ণ সুযোগ লাভ করে। ফলে সে অভাবী ও প্রার্থীদের যথাসাধ্য সহযোগিতায় মনোনিবেশ করে এবং আর্তমানবতার খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করার মহান শিক্ষা লাভ করে। এভাবে রমজান প্রকৃত অর্থেই বান্দার অপরাধ ও পাপাচারকে জ্বালিয়ে দেয় এবং মহান প্রভুর ক্ষমা ও রহমতের চাদরে নিজেকে আবৃত করতে পারার সৌভাগ্য লাভ করে।
রমজান হলো, নিজেকে আত্মশুদ্ধির চর্চায় উজ্জীবিত করার মাস। এ মাস হলো, সাধনার মাধ্যমে একজন সফল মু’মিন হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার। সব অনৈতিকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে পরিশুদ্ধি ও আত্মগঠনের প্রশিক্ষণ নেয়ার মাস রমজান। জীবনের সব ধরনের অনিয়মকে বিতাড়িত করে নিয়মতান্ত্রিকতার অনুশীলনের অনন্য মাস এটি। সেই প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনকে কাজে লাগাতে হয় সারা বছর। ইসলামে শরিয়ত নির্দেশিত বিধানগুলো কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়। ইবাদত করার পাশাপাশি, তার দর্শন ও অন্তর্নিহিত শিক্ষানুযায়ী জীবনযাপনের মধ্যেই রয়েছে ইবাদত পালনের সার্থকতা। আর রোজার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো তাকওয়া অর্জন। রোজার মূল উদ্দেশ্য হলো সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়াভিত্তিক জীবনাচরণে অভ্যস্ত হওয়া, আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা করা এবং তাঁর সব নিয়ামতের জন্য পূর্ণ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মহান রবের কাছে সমর্পণ করা।
ইরশাদ হয়েছে- ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ তথা আবশ্যক করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী মানুষের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া বা পরহেজগারি অর্জন করতে পারো।’ (সূরা বাকারা-১৮৩)
রমজান মু’মিন-মুসলমানের জীবনে পরিবর্তন আনার মোক্ষম সুযোগ। তাই রমজানের পর পরিবর্তিত জীবনে ফিরে যাওয়াই রমজানের দাবি। কেননা, রোজা নিছকই উপবাস থাকা, পানাহার ও কামাচার বর্জনের নাম নয়। এর বিশেষ তাৎপর্য ও দর্শন রয়েছে। রয়েছে এর দৈহিক, আত্মিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপকারিতা।
সারা দিন উপবাস থাকার ফলে শরীর ও আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয় এবং পাশবিকতার প্রাবল্য হ্রাস পায়। মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়, অন্তর বিগলিত হয় মহান প্রভুর কৃতজ্ঞতায়। মাহে রমজান হলো মানবিক কল্যাণবোধে উজ্জীবিত হওয়ার এক রাজপথ।
হাকিমুল উম্মাহ খ্যাত আল্লামা আশরাফ আলী থানভি রহ: বলেন, ‘মানুষের কুপ্রবৃত্তি ও আবেগের ওপর বিবেকের সর্বদা প্রভাব বিস্তার করা উচিত। কিন্তু মানবীয় দুর্বলতার কারণে অনেকসময় বিবেকের ওপর মানুষের আবেগ প্রাধান্য লাভ করে। তাই আত্মশুদ্ধি ও আত্মজাগৃতির জন্য ইসলাম রোজাকে মৌলিক ইবাদতগুলোর অন্তর্ভুক্ত করেছে। রোজা রাখার দ্বারা মানুষের কুপ্রবৃত্তি ও আবেগের ওপর বিবেক পরিপূর্ণভাবে বিজয়ী হয়। এতে তাকওয়ার গুণাবলি অর্জিত হয়। রোজা রাখার মাধ্যমে মানুষের নিজের অক্ষমতা ও অপারগতা এবং আল্লাহ তায়ালার বড়ত্ব ও কুদরতের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। রোজার মাধ্যমে অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়, দূরদর্শনের ধারণা প্রবল হয়। আসবাব ও উপকরণের হাকিকত খুলে যায়। পাশবিকতা ও পশুত্ব অবদমিত হয়। আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়। আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায়ের সুযোগ হয়। অন্তরে মানবিকতা ও সহমর্মিতার বন্যা বয়ে যায়।
রোজা দেহ-আত্মার সুস্থতার কারণ। রোজা মানুষের জন্য এক রুহানি খাদ্য, যা পরকালে মানুষের জন্য খাদ্যের কাজ দেবে। সর্বোপরি রোজা আল্লাহর ভালোবাসার অন্যতম নিদর্শন।
পবিত্র রমজান মানুষকে আত্মশুদ্ধি ও পুণ্য অর্জনের এক অবারিত সুযোগ এনে দেয়; যেখানে একটি নফল ইবাদত অন্য মাসের ফরজ ইবাদতের এবং রমজানের একটি ফরজ ইবাদত অন্য মাসের ৭০টি ফরজ ইবাদতের সমপর্যায়ের গুরুত্ব বহন করে থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই পবিত্র রমজান মাস মানুষের জীবনে সংশোধন লাভ ও অগণিত সওয়াবের বার্তা নিয়ে তার শুভাগমন ঘটায়। মানুষের উচিত হলো এমন পুণ্যময় ও বরকতের মাসকে সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ ইবাদতের মাধ্যমে ইহকালীন কল্যাণ অর্জন ও পারলৌকিক প্রত্যাশিত সাফল্যের সবটুকু লাভে আত্মনিয়োগ করা।
লেখক :
শিক্ষার্থী, জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া, আরজাবাদ
Leave a Reply