প্রত্যাবাসনের তালিকাভুক্ত থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি অংশের তথ্য যাচাই বাছাই করতে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের টেকনাফে অবস্থান করছেন। কিন্তু তারা যেসব রোহিঙ্গা শরনার্থীদের সাক্ষাতকার নিচ্ছেন ও তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন, তাদের অনেকেই বলছেন যে তারা এখনই মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী নন।
মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল এই দফায় টেকনাফ এসে যাদের সাথে দেখা করেছেন তাদের মধ্যে একজন মফিজ মিয়া (পরিবর্তিত নাম)। কুতুপালংয়ের একটি ক্যাম্পের ভেতরে নিজের ঘরে বসে মফিজ মিয়া ব্যাখ্যা করছিলেন, কেন তিনি মিয়ানমার ফেরার ব্যাপারে যথেষ্ট ভরসা পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন,‘আমার পরিবারের সদস্য ১১ জন। এর মধ্যে পাঁচ জনের নাম রয়েছে তালিকায়। শুধু এই পাঁচজনের সাথেই কথা বলেছে প্রতিনিধি দল। বাকি সদস্যদের সাথে কথাও বলেনি, তাদের ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কি করা হবে সে বিষয়ে কিছু জানায়নি আমাদের। পরিবারের সদস্যদের এখানে রেখে তো আমরা ফিরে যাবে না।’
মফিজ মিয়া বলছিলেন, মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গারা যদি তাদের আশ্বস্ত করে যে সেখানে তারা ভালো আছে ও তাদের পুরোনো বাসভূমি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী অত্যাচার করছে না, তাহলে তারা নিজেরাই ফিরে যাবে।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু সেরকম খবর যদি না পাই তাহলে শুধুমাত্র জোর করেই আমাদের নিয়ে যাওয়া যাবে। স্বেচ্ছায় আমরা যাব না।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আট লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠিয়েছিল। এরপর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ৬৮ হাজার রোহিঙ্গার একটি ফিরতি তালিকা পাঠানো হয়। গত বছর জানুয়ারিতে ওই তালিকা থেকে পরিবারভিত্তিক প্রত্যাবাসনের জন্য প্রাথমিকভাবে এক হাজার ১৪০ জনকে বাছাই করা হয় পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমার সম্মতি দিলেও বাকি ৪২৯ জনের ব্যাপারে তাদের আপত্তি ছিল। ওই ৪২৯ জনের তথ্য যাচাই-বাছাই করতেই মিয়ানমারের ১৭ জন সদস্যের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসেছেন।
কতৃর্পক্ষ কী বলছে?
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সাথে জড়িত প্রশাসনিক কর্মকর্তারা পুরো বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখলেও প্রত্যাবাসন কবে থেকে শুরু হতে পারে বা আদৌ শুরু হবে কিনা এবিষয়ে কোনো ধারণা দিতে পারেননি।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলছিলেন, পাইলট প্রকল্পটির পরিকল্পনা যেভাবে করা হয়েছিল সেটি সেভাবে পরিচালিত হয়নি।
তিনি বলেন, ‘২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩-এর মার্চ পর্যন্ত এক হাজার ১৪০ জনের তথ্য যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। তবুও তাদের ১৭ জনের বহর এসে যে এই কার্যক্রম চলমান রেখেছেন, এটিকেই আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি।’
মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা আশাবাদী যে একটা ব্রেক থ্রু হবে হয়তো। কিন্তু ১০ লাখের বেশি মানুষের মধ্যে তো এই এক হাজার ১৪০ জন কিছুই না। আমাদের আশাটা হচ্ছে যে এর মাধ্যমে একটা কিছু শুরু হবে হয়তো।’
তিনি আরো জানান, ‘যে প্রতিনিধিরা এসেছেন তাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে মন্তব্য করার কোনো এখতিয়ার নেই, প্রতিনিধিরা শুধুমাত্র সাক্ষাতকার নেবেন। তারা ক্যাম্প পরিদর্শন বা বৈঠক করার মতো কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেবেন না।’
এখানে সুযোগ-সুবিধা পেলে রোহিঙ্গারা কেন ফিরে যাবে
রোহিঙ্গারা বলছেন, তাদের দাবি মেনে নেয়া হলে তারা ফিরে যেতে চান। প্রশাসনও প্রতিনিধি দলের কার্যক্রমকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। কিন্তু বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গারা আসলেই তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে টেকনাফ ও কক্সবাজারের স্থানীয় মানুষের মধ্যে।
রোহিঙ্গারা এখানে যে শুধু বিভিন্ন এনজিওর কাছ থেকে অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী পায় তা নয়। তারা এখানে ব্যবসা করার সুযোগ পাচ্ছে, ক্যাম্পের ভেতরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ পাচ্ছে, স্থানীয়দের চেয়ে কম টাকায় কাজ করার কারণে স্থানীয় মানুষের দিনমজুরি বা কৃষিকাজের মতো অনেক কম দক্ষতার কাজও তাদের কাছে চলে যাচ্ছে।
টেকনাফে একটি মানবাধিকার সংস্থা পরিচালনা করা রবিউল হোসেন বলেছেন,‘এসব সুযোগ তারা মিয়ানমারে থাকতে কখনোই পেত না। এত সুযোগ-সুবিধা পেলে তারা কেন ফেরত যাবে?’
হোসেনের এসব দাবি যাচাই করতে উখিয়ার শরণার্থী ক্যাম্প সংলগ্ন কয়েকটি এলাকায় গিয়ে বোঝা গেল যে তিনি খুব একটা ভুল বলেননি।
উখিয়ার কুতুপালং বাজারটি যেখানে অবস্থিত, সেখান থেকে কিছুদুর হেঁটে গেলেই কুতুপালং শরণার্থী শিবির। আশপাশের এলাকার বাজারগুলোর চেয়ে এই বাজারটি আকৃতি ও বৈচিত্রে বেশ ভিন্নধর্মীই বলা যায়। এই বাজারের বিক্রেতাদের একটা বড় অংশ শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারা। ক্রেতাদেরও সিংহভাগই ক্যাম্পের বাসিন্দা।
স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দ নুর বলছিলেন, কয়েক বছর আগেও বাজারটিতে হাতে গোনা কয়েকটি দোকান ছিল। এখন বাজারে দোকানের সংখ্যা শতাধিক। বাজারের ব্যপ্তিও বেড়েছে বহুগুণে। বাজারের ভেতরে দোকানগুলোতে অধিকাংশ পণ্যই শরণার্থী শিবিরের ত্রাণের পণ্য। বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে ত্রাণ হিসেবে পাওয়া খাবার, বই, খাতা ও কম্বলের মতো নানা ধরণের পণ্য বিক্রি হতে দেখা গেল এই বাজারে।
ওই বাজারের একজন বিক্রেতার সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন যে এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি সেখানে দোকান চালাচ্ছেন।
তিনি বলছিলেন, মূলত ক্যাম্পে ত্রাণ হিসেবে পাওয়া পণ্যই তিনি বিক্রি করেন তার দোকানে। তবে গত বছরের চেয়ে এ বছর ত্রাণের পরিমাণ কমে যাওয়ায় তার দোকানে বেচাকেনা আগের চেয়ে কমে গেছে।
তিনি আরো জানান, ওই বাজারে তার মতো ৬০-৭০ জনের দোকান রয়েছে যারা মূলত ত্রাণ হিসেবে পাওয়া পণ্য বিক্রি করেই ব্যবসা চালান। দোকানের ব্যবসা ছাড়া ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকাগুলোতে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চালানো বা দিনমজুরির মতো অনেক কাজই করে থাকে শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গারা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে কাজ করায় তাদের এলাকায় দিনমজুরি, কৃষিকাজের মতো কম দক্ষতার অনেক কাজ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছে চলে যাচ্ছে, যার ফলে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমানও এই সমস্যার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলছিলেন, এই সমস্যা সমাধানে বিদেশি দাতা সংস্থা ও এনজিওগুলোর সাথে শুরু থেকেই আলোচনা করে আসছে কতৃর্পক্ষ।
তিনি বলেন, বিপুল পরিমাণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপস্থিতিতে আমাদের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যে সমস্য তৈরি হয়েছে তা নিরসনে প্রশাসন সবসময়ই চেষ্টা করছে। এখানে কাজ করা এনজিওগুলোকেও আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি যে তাদের ফান্ডের অন্তত ২৫ ভাগ যেন স্থানীয়দের জন্য ব্যয় করা হয়।
তিনি আরো বলেন, ‘সেটা আমরা কম-বেশি চেষ্টা করছি, কিন্তু শতভাগ করা সম্ভব হচ্ছে তা নিশ্চয়তার সাথে বলা সম্ভব নয়।’
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply