জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ২৪ দিন পর স্বদেশে ফেরেন। এর পর সংবিধান প্রণয়নে গঠন করা হয় বাংলাদেশ গণপরিষদ (বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ)। ঢাকার তেজগাঁওয়ে তৎকালীন সংসদ ভবনে গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল। সেদিন সকাল ১০টায় গণপরিষদে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষণের চুম্বকাংশ তুলে ধরা হলো-
‘স্পিকার সাহেবের অনুমতি নিয়ে আমি একটা শোক-প্রস্তাব উত্থাপন করতে চাই। জনাব স্পিকার সাহেব, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে বাংলার যে লক্ষ লক্ষ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের মহান আত্মার প্রতি এই পরিষদ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে এবং তাদের শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে যে সমস্ত মাননীয় পরিষদ সদস্য তাঁদের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে উজ্জীবিত করেছেন, সেই সমস্ত স্মরণীয় ও বরণীয় বীর সহকর্মী সদস্যদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এই পরিষদ শোক জ্ঞাপন করছে।
এই সমস্ত সংগ্রামী নেতার বিদেহী আত্মার সাথে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শহীদ ভাই-বোনেরা, যারা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আত্মবলি দিয়েছেন ও ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, তাদের জন্য এই পরিষদ আত্মদানের গৌরবময় স্মৃতিকে চিরকাল স্মরণ রাখবে।
নিষ্ঠুর বর্বর ইয়াহিয়া খানের খান সেনারা যে অত্যাচার করেছে, জুলুম করেছে, তা থেকে বাংলাদেশের মা-বোনেরা পর্যন্ত নিস্তার পায়নি। লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে নির্যাতন করা হয়েছে। এই পশু সেনাদের আচরণের ইতিহাস দুনিয়ায় আর কোথাও নাই।
জনাব স্পিকার সাহেব, আজ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, এর সঙ্গে সঙ্গে আমি চারটি স্তম্ভকে স্মরণ করতে চাই যে স্তম্ভকে সামনে রেখে আমাদের দেশের সংবিধান তৈরি করতে হবে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
আমরা গণতন্ত্র দিতে চাই এবং গণতন্ত্র দিতেই আজ আমরা এই পরিষদে বসেছি। কারণ আমরা যে সংবিধান দেব, তাতে মানুষের অধিকারের কথা লেখা থাকবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। এমন সংবিধানই জনগণের জন্য পেশ করতে হবে। আজ এখানে বসে চারটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এমন সংবিধান রচনা করতে হবে, যাতে তাঁরা দুনিয়ার সভ্য দেশের মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।
বর্বর ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীকে অসহায় ও নিরস্ত্র শত কোটি বাঙালির ওপর কুকুরের মতো লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেনাবাহিনী যদি যুদ্ধ ঘোষণা করত, তবে আমরা সেই যুদ্ধের মোকাবিলা করতে পারতাম।
তারা অতর্কিত ২৫ মার্চ তারিখে আমাদের আক্রমণ করল। তখন আমরা বলতে পারলাম যে, আমাদের শেষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে।
আমি ওয়্যারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই খবর প্রত্যেককে পৌঁছিয়ে দেওয়া হোক, যাতে প্রতিটি থানায়, মহকুমায়, জেলায় প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠতে পারে। সেই জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়েছিলাম। এই ব্যাপারে আত্মসচেতন হতে হবে।
আমরা দেখতে পাই আমাদের লক্ষ লক্ষ মা-বোনদের অত্যাচার করা হয়েছে এবং আমাদের হাজার হাজার ছেলে পঙ্গু অবস্থায় রয়েছে, তাদের জন্য কিছু করতে পারি নাই। আমাদের বাংলার গ্রাম-কে-গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। আমাদের ধন-সম্পত্তি লুটপাট করে নিয়ে গেছে, রাস্তাঘাট ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, আমাদের কারেন্সি নোট জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ রকম কত নির্যাতনই না আমাদের লোককে সহ্য করতে হয়েছে এবং তারা যে সহনশীলতা দেখিয়েছেন, সে জন্য তাদেরকে যদি আমরা মোবারকবাদ না জানাই তাহলে অন্যায় করা হবে।
আমাদের সামনে আজকে বিশেষ কর্তব্য হলো জাতিকে একটা সংবিধান দেওয়া এবং যত তাড়াতাড়ি হয়, সেই সংবিধান দিবার চেষ্টা করা হবে।
আজকে আমাদের জনগণ কী অসুবিধায় আছে। তাদের থাকার ঘর নেই; আমরা কিছু দিতে পারছি না; মানুষ কষ্ট করছে। হাজার হাজার লোক বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে; তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছি না। অর্থ নাই, জনসাধারণকে সুবিধা করে দিতে পারছি না। কিন্তু আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনার কাছে আবার বলছি যে, আমাদের সামনে কর্তব্য হলো সংবিধান তৈরি করা।
শুধু যে আমাদের দলীয় সদস্য থেকে কমিটি করব তা নয়, দলমত নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। জনগণকে যেন তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী একটা সুষ্ঠু সংবিধান দেওয়া যায়, এই উদ্দেশ্যে সকলের মতামত চাইব। এই সংবিধানে মানবিক অধিকার থাকবে, যে অধিকার মানুষ চিরজীবন ভোগ করতে পারে। আমরা একটি গণমুখী সংবিধান তৈরি করতে চাই।
এই পরিষদ বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার সেই সব মূর্ত আদর্শ, যথা- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করছে।’
Leave a Reply