তুরস্কে ভূমিকম্পের ২৯৬ ঘণ্টা পর ধসে পড়া ভবন থেকে শিশুসহ তিনজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। শনিবার দক্ষিণ তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের ১২ দিন পার হওয়ার পর তাদের উদ্ধার করা হয়। তুরস্কের গণমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, শনিবার দেশটির দক্ষিণ হাতায় প্রদেশের ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি শিশুসহ আরো তিনজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। ওই অঞ্চলে দু’টি ভয়াবহ ভূমিকম্পের প্রথম আঘাতের ২৯৬ ঘণ্টারও বেশি সময় পরে এমন অলৌকিক উদ্ধারকাজ সম্পন্ন হয়।
এরই মধ্যে ভয়াবহ এ দুর্যোগে নিহতের সংখ্যা ৪৫ হাজার ছাড়িয়েছে বলে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার খবরে জানানো হয়েছে। শনিবার এ তথ্য প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে শুধু তুরস্কেই নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৩৯ হাজার ৬৭২। অন্যদিকে সিরিয়ার সরকার ও জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সিরিয়ার অংশে এই ভূমিকম্পের ফলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৮০০ এরও বেশি। তুরস্কে গত ১০০ বছরের মধ্যে এটা সবচেয়ে মারাত্মক ভূমিকম্প।
অন্যদিকে তুরস্কের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ‘প্রাথমিকভাবে কানাতলি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ধ্বংসাবশেষ থেকে বাবা-মা এবং তাদের ১২ বছরের শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তবে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকা সত্তে¡ও পরে শিশুটির মৃত্যু হয়। সামির মোহাম্মদ আকর এবং তার স্ত্রী রাগদাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। ওই দম্পতির আরও দুই সন্তানও একই ধ্বংসস্তূপে প্রাণ হারায়। ৬ ফেব্রুয়ারি মারাত্মক ভূমিকম্পের সংঘটনের পর ১৩তম দিনে একটি অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল আন্তাকিয়া জেলার ওই ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসাবশেষ থেকে বেঁচে যাওয়া এ ব্যক্তিদের বের করে এনেছে।
৭.৭ ও ৭.৬ মাত্রার ওই ভূমিকম্পগুলো দেশটির কাহরামানমারাস প্রদেশকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে। এ শক্তিশালী ভূমিকম্পে তুরস্কের আরো ১০ প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রদেশগুলো হলো : আদানা, আদিয়ামান, দিয়ারবাকির, হাতায়, গাজিয়ানটেপ, মালটিয়া, কিলিস, ওসমানিয়ে, এলাজিগ এবং সানলিউরফা। এ বিধ্বংসী ভূমিকম্পে এক কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিরিয়া এবং লেবাননসহ এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ ১০ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে তুরস্কে আঘাত করা শক্তিশালী কম্পন অনুভব করেছে।
তুর্কি দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা প্রেসিডেন্সি (আফাদ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বর্তমানে উদ্ধার অভিযানে দুই লাখ ৬৪ হাজার ৩৮৯ জনেরও বেশি কর্মী মাঠে কাজ করছে। আফাদ জানিয়েছে, ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৮ হাজার ৪৪ জনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে তুরস্কের সাথে সংহতি প্রকাশ করে বিশ্বজুড়ে সমবেদনা জানানো হচ্ছে। অনেক দেশ উদ্ধারকারী দল এবং সহায়তা পাঠিয়েছে।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৬৭টি দেশের মোট পাঁচ হাজার ৭৫৩ জন বিদেশী কর্মী বর্তমানে দুর্যোগকবলিত অঞ্চলে কাজ করছে। তুর্কি কর্তৃপক্ষ আরো জানিয়েছে, ‘১০১টি দেশ এ পর্যন্ত সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। আরো দু’টি দেশ উদ্ধারকারী দল পাঠাবে বলে আশা করা হচ্ছে।’
৩০ হাজার বাড়ি বানাবে তুরস্ক :
জোড়া ভূমিকম্প থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য আগামী মাসে ব্যাপকভাবে বাড়ি নির্মাণ শুরু করবে তুরস্ক। এরই মধ্যে ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত প্রদেশে নতুন বসতি স্থাপনের এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এরদোগান সরকার। দেশটি জানিয়েছে, ৩০ হাজার বাড়ি নির্মাণ করা হবে। তুরস্কের পরিবেশ, নগরায়ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মুরাত কুরুম শুক্রবার ভূমিকম্প-পরবর্তী পুনর্নিমাণ প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়ে বলেন, নির্মাণ কাজ মার্চের মধ্যে শুরু হবে।
কুরুম বলেন, নতুন নির্মাণের জন্য জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। মুরাত কুরুম বলেন, নতুন ভবনগুলো তিন থেকে চার তলার বেশি হবে না এবং পরিকল্পনা করা হবে স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও রীতিনীতি অনুযায়ী। কুরুম আরো বলেন, তুরস্ক শতাব্দীর বিপর্যয়কর ভূমিকম্পে হওয়া ক্ষতির মূল্যায়ন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৭ হাজার ৩২৮ জন বিশেষজ্ঞ ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে নিয়োজিত রয়েছেন। এ পর্যন্ত তারা ছয় লাখ ৮৪ হাজার ভবনের প্রায় ৩০ লাখ অ্যাপার্টমেন্ট পরিদর্শন করেছেন।
মন্ত্রী বলেন, ৯০ হাজার ৬০৯টি ভবনের মধ্যে তিন লাখ ৪৫ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট হয় সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা জরুরিভাবে ভেঙে ফেলার প্রয়োজন। তুর্কি কর্মকর্তারা বলছেন, বিধ্বংসী ভূমিকম্পে এক কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘানার ফুটবলার আতসুর লাশ উদ্ধার :
তুরস্কে ভূমিকম্পের ঘটনায় নিখোঁজ হওয়া ঘানা ও চেলসির সাবেক ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ান আতসুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয় গণমাধ্যমের সূত্রে শনিবার বেন স্পোর্টস ও নিউজ স্ট্রেট টাইমস এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ৭.৮ ও ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে অন্যানদের সাথে নিখোঁজ হন তুর্কি সুপার লিগের ক্লাব হাতাইস্পোরে মিডফিল্ডার আতসু।
ভূমিকম্পের একদিন পর তাকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে গুঞ্জন উঠে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ঘানার রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে আতসুকে। তবে শেষ পর্যন্ত সংবাদটি মিথ্যা প্রমাণ হয়। আতসুর ম্যানেজার মুরাত উজুনমেহমেত শনিবার বার্তা সংস্থা ডিএইচএ’কে বলেন, তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ হাতায়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে তার লাশ পাওয়া গেছে। মুরাত আরো বলেন, আমরা তার প্রাণহীন দেহে পৌঁছেছি। তার জিনিসপত্র এখন সরানো হচ্ছে। তার ফোনও পাওয়া গেছে।
সূত্র : আনাদোলু এজেন্সি, টিআরটি ওয়ার্ল্ড ও আলজাজিরা
Leave a Reply