আজকাল মুসলিম সমাজে বিয়েটা হয়ে গেছে আনুষ্ঠানিক বিষয়। অথচ মুসলিম বিবাহ আইনানুযায়ী বিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিষয় নয়। কিন্তু আমরা বেশির ভাগ মুসলিম বিপরীতমুখী। ইদানীং বিয়ের অনুষ্ঠান তো চোখে পড়ার মতো। থাকে হাজার হাজার টাকার জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন। এতে থাকে কয়েকটি আনুষ্ঠানিক পর্ব; পানচিনি, মেহেদি রাত, গায়ে হলুদ ও বৌভাত ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো সবই এখন সামাজিকতার অংশ হয়ে গেছে। অথচ এগুলো ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে আসা বা মানুষের মনগড়া তৈরি আনুষ্ঠানিকতা।
ইসলামে বিয়ে মানে নিকাহ বা ওয়ালিমা। কত সহজ এক পদ্ধতি। কিন্তু না, আমাদের সব অনুষ্ঠান করতেই হবে। নইলে মানুষের সামনে নিজের মান চলে যাওয়ার মতো! অমুকে কী বলবে, তমুকে কী বলবে, সমাজের মানুষ কী বলবে- এই ভেবেই অনেকে বিশাল ঋণের বোঝা নিয়ে সামাজিকতা রক্ষা করতে গিয়ে নিজের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। এই অতিরিক্ত বাড়তি কষ্ট আদৌ কি ইসলাম সমর্থন করে? না, বিয়েতে এত আনুষ্ঠানিকতা বলতে কিছু নেই। ইসলামে বিয়ে বা নিকাহ দ্বীনের একটি সৌন্দর্য; কিন্তু আমরা নিজেরাই এটিকে জটিল থেকে আরো জটিলতর করে ফেলেছি।
আমাদের সমস্যা যত শুরু হয়, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা থেকেই। ফলে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় মানসিক চাপ ও কদর্যতা। সমাজে আরেকটি বিষয় খুবই লক্ষণীয়, শুক্রবার হচ্ছে পবিত্র দিন। তাই এই পবিত্র দিনকে ঘিরেই বেশির ভাগ মুসলিম দিনটিকে বেশি প্রাধান্য দেয়। আচ্ছা ঠিক আছে। তবে বিয়ের সাথে আনুষ্ঠানিক বিষয় থাকছেই, সাথে থাকছে মানুষকে কষ্ট দেয়ার মতো ধুমধারাক্কা বাদ্য! তখন আর পবিত্র দিনের খেয়াল থাকে না। আমরা খুবই নির্বোধ এক প্রাণী। বুঝেও বুঝে উঠতে পারি না। পবিত্র এক বন্ধনকে, আল্লাহ তায়ালার হালাল বিষয়টিকে হারামের সাথে মিশিয়ে ফেলছি না তো?
ইসলামে বিয়ে : বিয়ে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত ও রাসূল সা:-এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ। চারিত্রিক অবক্ষয় রোধের অনুপম হাতিয়ার। আদর্শ পরিবার গঠন, মানুষের জৈবিক চাহিদাপূরণ ও মানবিক প্রশান্তি লাভের প্রধান উপকরণ। বিয়ে ইসলামী শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আল্লাহর নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ‘তিনি তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জীবনসঙ্গিনী, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পারো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করে দিয়েছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ (সূরা রুম, আয়াত-২১)
ইসলামে বিয়ের মৌলিক ভিত্তি : ১. বর-কনে উভয়ে বিয়ে সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে সবধরনের প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত হওয়া।
২. ইজাব বা প্রস্তাবনা : এটি হচ্ছে বরের কাছে মেয়ের অভিভাবক বা তার প্রতিনিধির পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব উপস্থাপন করা। যেমন- ‘আমি অমুককে তোমার কাছে বিয়ে দিলাম’ অথবা এ ধরনের অন্য কোনোভাবে প্রস্তাব পেশ করা।
৩. কবুল বা গ্রহণ করা : এটি বর বা তার প্রতিনিধির সম্মতিসূচক বাক্য। যেমন- ‘আমি কবুল বা গ্রহণ করলাম’ ইত্যাদি।
বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার শর্ত : ১. বর-কনে উভয়কে গ্রহণযোগ্যভাবে নির্দিষ্ট করে নেয়া।
২. বর-কনে একে অন্যের প্রতি সন্তুষ্ট হওয়া। রাসূল সা: বলেন, ‘স্বামীহারা নারীকে (বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা) তার সিদ্ধান্ত ছাড়া (অর্থাৎ পরিষ্কারভাবে তাকে বলে তার কাছ থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে) বিয়ে দেয়া যাবে না। কুমারী মেয়েকে তার সম্মতি (কথার মাধ্যমে অথবা চুপ থাকার মাধ্যমে) ছাড়া বিয়ে দেয়া যাবে না। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা:! কেমন করে তার সম্মতি জানব? তিনি বললেন, চুপ করে (লজ্জার দরুন) থাকাটাই তার সম্মতি।’ (বুখারি- ৪৭৪১)
বিয়েতে নারীর সম্মতি বা পছন্দ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিয়ে হচ্ছে আজীবন অটুট থাকার বন্ধন। হাদিসে এসেছে- ‘খুনাসা নামে এক নারীকে তার পিতা বিয়ে দেন। এই বিয়ে তার পছন্দ ছিল না। এর পর রাসূল সা:-এর কাছে গেলে তিনি এই বিয়ে বাতিল করে দেন। (সহিহ বুখারি- ৪৭৬২
৩. বিয়ে হচ্ছে সামাজিক একটি চুক্তি। তাই বিয়ের চুক্তি করানোর দায়িত্ব মেয়ের অভিভাবককে পালন করতে হয়। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা বিয়ে দেয়ার জন্য অভিভাবকদের প্রতি নির্দেশনা জারি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর তোমরা তোমাদের মধ্যে অবিবাহিত নারী-পুরুষদের বিবাহ দাও।’ (সূরা নূর- ২৪:৩২)
হাদিসে এসেছে- রাসূল সা: বলেন, ‘যে নারী তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করবে তার বিয়ে বাতিল, তার বিয়ে বাতিল, তার বিয়ে বাতিল।’ (তিরমিজি- ১০২১)
৪. বিয়ের সাক্ষী : সাক্ষী এমন দু’জন পুরুষ (স্বাধীন) সাক্ষী বা একজন পুরুষ (স্বাধীন) ও দু’জন মহিলা সাক্ষী হতে হবে, যারা প্রস্তাবনা ও কবুল বলার উভয় বক্তব্য উপস্থিত থেকে শুনতে পায়। (আদ-দুররুল মুখতার-৩/৯; ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়া-১/২৬৮)
বিয়ের ক্ষেত্রে কনের অভিভাবক হওয়ার প্রয়োজনীয় শর্ত- ১. সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন হওয়া; ২. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া; ৩. দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়া; ৪.অভিভাবক কনের ধর্মানুসারী হওয়া। সুতরাং কোনো অমুসলিম ব্যক্তি মুসলিম নর-নারীর অভিভাবক হতে পারবে না;
৫. ন্যায়পরায়ণ হওয়া। অর্থাৎ ফাসেক না হওয়া। কিছু কিছু আলেম এ শর্তটি আরোপ করেছেন। অন্যরা বাহ্যিক ‘আদালত’কে (ধর্মভীরুতা) যথেষ্ট বলেছেন। আবার কারো কারো মতে, যাকে তিনি বিয়ে দিচ্ছেন তার কল্যাণ বিবেচনা করার মতো যোগ্যতা থাকলেও চলবে; ৬.পুরুষ হওয়া। নবী সা: বলেন, ‘এক নারী অন্য নারীকে বিয়ে দিতে পারবে না। অথবা নারী নিজে নিজেকে বিয়ে দিতে পারবে না। ব্যভিচারিণী নিজে নিজেকে বিয়ে দেয়।’ (ইবনে মাজাহ- ১৭৮২, সহিহ জামে-৭২৯৮); ৭. বিয়ের ক্ষেত্রে বর-কনের ‘কুফু’ বা সমতা ও অন্যান্য কল্যাণের দিক বিবেচনা করতে পারার যোগ্যতাবান হওয়া।
ফিকাহবিদরা অভিভাবকদের ধারা নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং কাছের অভিভাবক থাকতে দূরের অভিভাবকের অভিভাবকত্ব গ্রহণযোগ্য নয়। কাছের অভিভাবক না থাকলে দূরের অভিভাবক গ্রহণযোগ্য হবে। সুতরাং ইসলাম আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছে। অথচ আমরাই এর ব্যবহার যথাযথভাবে করছি না। আমরা কঠিনের দিকে ধাবিত না হয়ে সহজ পথে আসার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সেই তৌফিক দান করুক। আমিন।
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
Leave a Reply