নবম হিজরি। রমজান মাস। প্রচণ্ড তাপদাহে মদিনাবাসীর জীবন ওষ্ঠাগত। আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরছে। সূর্য অগ্নিরূপ ধারণ করেছে। মদিনার অলি-গলিতে বয়ে যাচ্ছে লু-হাওয়া। বাগানে থোকায় থোকায় খেজুর হলুদাভ হয়ে উঠেছে। একদিকে খাদ্যসঙ্কট অন্যদিকে নতুন ফসলের হাতছানি। এমন সময় ডাক এলো তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ পরাশক্তি রোম সাম্রাজ্যের সাথে জিহাদের। মদিনা থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দূরের পথে যাত্রা শুরু করলেন প্রিয় রাসূল সা: ও তাঁর জিহাদি কাফেলা। মাথার ওপর সূর্যের তীব্র প্রখরতা আর পায়ের নিচে পাথুরে মাটি যেন অগ্নিগোলা!
খাদ্যসঙ্কট, যুদ্ধের সরঞ্জাম ও রসদের তীব্র অভাব আর সমস্ত প্রতিকূলতাকে নবী সা:-এর প্রেমে ভাসিয়ে দিয়ে ছুটে চলল কাফেলা। মদিনা প্রায় খালি হয়ে গেল। শুধু মুনাফিক আর মুষ্টিমেয় কয়েকজন সাহাবি ছাড়া বাকি সবাই শহীদী শূরা পানের তীব্র আকাক্সক্ষায় তাবুকের পথে। যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন মদিনায় রয়ে গেলেন তাদের মধ্যে একজন সাহাবি হজরত আবু খায়সামা রা:। কাফেলায় যোগ না দেয়ায় তার মনে শান্তি নেই তাই তিনি বাগানে গিয়ে পায়চারি করছেন। নয়নাভিরাম খেজুর বাগান, পাকা খেজুরের হাতছানি, বাগানের শীতল ছায়া কোনো কিছুই ভালো লাগছে না।
সব কিছু থাকার পরও হৃদয়ে যেন কীসের হাহাকার! কোথাও শান্তি নেই, সময়গুলো যেন ভারী হয়ে আসছে। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করছেন আবু খায়সামা রা:। প্রিয় স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য দুই স্ত্রী বাগানের মধ্যে গাছের ছায়ায় নরম বিছানা পেতে দিলেন, শীতল পানি আর বাহারি খাবারের আয়োজন করলেন; কিন্তু পৃথিবীর কোনো ঐশ্বর্য তার কাছে ভালো লাগছে না। তিনি ভাবতে লাগলেন মানবতার মুক্তির দূত, শাফায়াতের কাণ্ডারি, আল্লাহর প্রিয় রাসূল সা: উত্তপ্ত পাথুরে পথ পাড়ি দিচ্ছেন আর আমি আরামদায়ক বিছানায় বিশ্রামে থাকব! না, তা কখনো হতে পারে না। তার রক্ত প্রবাহে নবী সা:-এর প্রেমের ঢেউ বয়ে গেল। অন্তরাত্মায় প্রচণ্ড এক ঝড় উঠল। সাথে সাথে পার্থিব সুখের সব আয়োজনকে দুমড়ে মুছড়ে রওনা হলেন তায়েফের পথে, নিজেকে বিলীন করে দিলেন নবী সা:-এর প্রেমের সুগভীর সমুদ্রে। আবু খায়সামা ময়দানে পৌঁছলে প্রিয় নবী সা: তাকে সম্বোধন করে বললেন, ‘ধ্বংসের উপত্যকা থেকে তুমি বের হয়ে এসেছ, তোমাকে স্বাগতম।’
এই রকম অসংখ্য ত্যাগের সমুজ্জ্বল সাধনায় ভাস্বর ছিল প্রিয় নবী সা:-এর সাহাবায়ে কেরামদের জীবন। কারণ তারা আল্লাহর নির্দেশ ও প্রিয় নবী সা:-এর বাণীকে বুকে ধারণ করেছিলেন এবং যথার্থ বাস্তবায়ন করেছিলেন। মহান রবের ঘোষণা হলো- ‘কেউ যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চায় সে যেন প্রিয় নবী সা:-এর আনুগত্য করে।’ আর আল্লাহর হাবিবের বাণী হলো, ‘ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে বেশি প্রিয় হবো না তার মাতা-পিতা, সন্তান-সন্ততি, সব মানুষ ও সব কিছুর চেয়ে’(বুখারি)। প্রিয় নবী সা:-এর প্রতি ভালোবাসার এই মানদণ্ডের দ্বারা প্রত্যেকে নিজ নিজ ঈমান যাচাই করে নিতে পারেন।
অন্যথায় নিজের ব্যাপারে সতর্ক হোন; এখনো সংশোধন হওয়ার সময় আছে। আজকে আমরা মাহে রবিউল আউয়াল এলেই কেবল নবীপ্রেমের চর্চা করি। অন্যান্য পার্থিব বিষয়ের মতো দ্বীনের বিষয়কেও যেন আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি! মিলাদুন্নবীর মাস এলে আমাদের মনে পড়ে রাসূলে আকরাম সা:-এর আগমনে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের অমানিশার কালো মেঘ সরে গিয়ে পৃথিবী আলোর মুখ দেখেছিল। পাপাচার আর মূর্খতার অভিশপ্ত রাত পেরিয়ে সৌভাগ্যের আলো ঝলমল প্রভাত এসেছিল। এ মাসেই আমাদের মনে পড়ে মানবাধিকারবঞ্চিত সমাজে প্রিয় নবী এসেই মানবাধিকারের বীজ বপন করেছিলেন, ফিরিয়ে দিয়েছেন নারীর অধিকার ও বসিয়েছেন সম্মানের এক অনন্য উচ্চতায়। অত্যাচার, অনাচার আর সব অনৈতিকতা প্রতিকারের মহৌষধ নিয়ে তিনি পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন, মানবতাকে ধ্বংসের উপত্যকা থেকে টেনে তুলে সত্যিকারের এক মানবিক সমাজ উপহার দিয়েছিলেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। কিন্তু কীভাবে তিনি এসব করেছিলেন তার কথা আমাদের স্মরণে আসে খুবই কম। আমরা ভুলে গেছি প্রিয় রাসূলের সংগ্রামী জীবনের কথা, তাঁর ওপর কাফের মুশরিকদের অত্যাচারের কথা। আমরা ভুলে গেছি তাঁর শিক্ষানীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও সমরনীতির কথা। দু’জাহানের বাদশাহ হওয়ার পরও অতি সাধারণ জীবন যাপনের কথা আমরা ভুলে গেছি।
আমরা ভুলে গেছি কাবার অভ্যন্তরের ৩৬০ মূর্তি অপসারণ করে ওইসব মূর্তিপূজকদের কীভাবে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়ে খাঁটি ঈমানদার বানিয়েছেন। ভুলে গেছি তায়েফের ময়দানে পাথরে পাথরে জর্জরিত হওয়ার রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা। ভুলে গেছি বদরের ময়দানে অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ, উহুদের রক্তের স্র্রোতধারা, খন্দকের ভয়াল রাতের কঠিন পরীক্ষা, হুনায়নের যুদ্ধে শত্রুদের তীরবৃষ্টি, তাবুকের চামড়া ঝলসে দেয়া সূর্যতাপ! প্রিয় নবীর হিজরতের কথা, প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যাওয়ার সে কী বেদনা, প্রিয় নবীর প্রিয় সাহাবিদের জ্বলন্ত কয়লার ওপর টানা হেঁচড়া করা, গলায় রশি পেঁচিয়ে মক্কার গলিতে ঘুরানোর নির্মমতা আমরা ভুলে গেছি। আমরা ভুলে গেছি আল-আরওয়া থেকে তাবুক পর্যন্ত ২৭টি যুদ্ধে প্রিয় নবীর সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা। আমাদের মনে পড়ে না শিআবে আবি তালিবে বর্ণনাতীত কষ্ট আর যাতনার সেই নির্বাসনের কথা। আজকে আমরা রাসূল প্রেমের কথা বলি অথচ নিজেদের কথা-কাজে, চিন্তা-চেতনায়, শিক্ষা-দীক্ষায় কতটুকু তা লালন করি- এটি বিরাট প্রশ্নসাপেক্ষ। যে রাসূল সা: সারা জীবনে উম্মতের জন্য কেঁদেছেন সেই উম্মত হয়ে আমরা কতটুকু কী করছি তা ভাবার বিষয়। আল্লাহর জমিনে দ্বীন ইসলামকে প্রতিষ্ঠার জন্য রাসূল সা: সারা জীবন যে সাধনা ও ত্যাগ করেছেন তা নিজেদের জীবনে কতটুকু ধারণ করি বা রাসূল সা:-এর প্রেমে নিজেদের সঁপে দেয়ার জন্য আমরা কতটুকু প্রস্তুত তা গভীরভাবে ভাবতে হবে!
সময় এসেছে চিন্তার পরিধিকে প্রসারিত করে আনুষ্ঠানিকতার বাহুল্যতাকে প্রাধান্য না দিয়ে মৌলিকত্বের দিকে বেশি বেশি ফোকাস করা। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রিয় নবী সা:-এর দর্শন চর্চা করে ইসলামের সুমহান ও কালজয়ী আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করা। মিলাদুন্নবী সা: উদযাপন আনুষ্ঠানিকতায় ভরপুর না করে আমাদের প্রিয় নবী সা:-এর পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন নিজেদের জীবনে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে তা কীভাবে বিস্তৃত করা যায় সেই বিষয়ে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া অতীব জরুরি। জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রিয় নবীর আদর্শের প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে অনুষ্ঠাননির্ভর মিলাদুন্নবী সা: পালন আমাদের জীবনে সামগ্রিক কোনো পরিবর্তন আনবে না। আল্লাহ! আমাদের সবাইকে তোমার প্রিয় হাবিব সা:-এর পথে ও মতে জীবন অতিবাহিত করার তওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সৌদি আরব থেকে
Leave a Reply