কুফর অর্থ হলো- গোপন করা, লুকিয়ে ফেলা, আবৃত করা, অস্বীকার করা, সত্যকে গোপন করা, অন্ধকার, ঈমানের বিপরীত, ঢেকে ফেলা ইত্যাদি। পরিভাষায়- লিসানুল আরব প্রণেতার মতে, কুফর হচ্ছে অন্তর ও জিহ্বার মাধ্যমে কোনো কিছুকে অস্বীকার করা এবং তাওহিদ সম্পর্কে কোনো কিছু উল্লেøখ করলে সেটি বুঝতে চেষ্টা না করা।
মুজামুল ওয়াসিত প্রণেতার মতে, কুফর হচ্ছে আল্লাহর একত্ববাদ অথবা শরিয়ত অথবা একই সাথে উপরিউক্ত তিনটির কোনোটির প্রতি ঈমান আনয়ন না করা। শরিয়তের পরিভাষায়, মহান আল্লøাহর অস্তিত্ব ও ইসলামের মৌলিক বিধিবিধান অস্বীকার করাকে কুফর বলে। কুফরি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে কাফির বলা হয়।
কুফরের প্রকারভেদ
দালা ইলুত তাওহিদের গ্রন্থকার মুহাম্মদ ইবনে সুলায়মান রহ: কুফরকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
ক. কুফরু ইয়াখরুজু মিন মিল্লাতি : (কুফর মিল্লøাতে ইবরাহিম থেকে বের করে দেয়)
খ. কুফরু আসগারু লা ইয়াখরুজু মিন মিল্লাতি : (কুফর মিল্লøাতে ইবরাহিম থেকে বের করে দেয় না)
ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সুলায়মান আততাজিমি এই কুফরকে আবার পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন : যথা-
কুফরুত তাকজিব : অন্তর ও মৌখিকভাবে আল্লøাহর একত্ববাদ এবং রাসূল সা:-এর রিসালাত অস্বীকার করাকে কুফরুত তাকজিব বলে। যেমন- পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘তার চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে? যে আল্লøাহর ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ দেয় অথবা সত্য জিনিসকে অস্বীকার করে তাদের কাছে সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর। কাফেরদের আবাসস্থল কি জাহান্নাম নয়’ (সূরা আনআম-২১)?
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা কুফরি করেছে, তাদের ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত হলো, আপনি তাদেরকে ভয় দেখান আর না দেখান, তারা কখনোই ইমান আনবে না’ (সূরা বাকারা-৬)।
কুফরুল ইসতিকবার ওয়াল আবাঈ মাআত তাছদিক : (সত্য জানা সত্ত্বেও কুফরি অহঙ্কারবশত কুফরি করা) পবিত্র কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছে- ‘যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম যে, তোমরা আদমকে সিজদা করো, তখন তারা সিজদা করল ইবলিস ব্যতীত, সে অস্বীকার করল এবং অহঙ্কার করল। অতঃপর সে কাফিরদের অন্তর্র্ভুক্ত হয়ে গেল’ (সূরা বাকারা-৩৪)।
কুফরুশ শাক : (সন্দেহ বা ধারণাবশত কুফরি করা) ইরশাদ হচ্ছে- ‘নিজের প্রতি জুলুম করে সে তার বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমার মনে হয় না যে, এ বাগান কখনো ধ্বংস হয়ে যাবে’ (সূরা কাহাফ-৩৫)।
কুফরুল আরাজ : (বিমুখতাবশত কুফরি করা) যেমন- পবিত্র কুরআনে এসেছে- ‘এবং যারা কুফরি করেছে, তাদেরকে ভয় দেখানোর পরও, সুতরাং তারা বিমুখতাবশত কুফরি করল’ (সূরা আহকাফ-৩)।
কুফরুন নিফাক : (মুখে স্বীকার করে অন্তরে অস্বীকার) ইরশাদ হয়েছে- ‘এটি এ কারণে যে, তারা ইমান এনেছে তারপর আবার কুফরি করেছে অতঃপর তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা বুঝতে পারে না’ (সূরা মুনাফিকুন-৩)।
কুফরু আসগারু লা ইয়াখরুজু মিন মিল্লøাতি-এর বর্ণনা : এটি এমন ছোট কুফর যা তাদেরকে দ্বীন তথা মিল্লøাত থেকে বের করে দেয় না। যেমন- নিয়ামতের অস্বীকার। ইরশাদ হচ্ছে- ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন একটি গ্রামের উপমা পেশ করেছেন, যে গ্রামটি ছিল প্রশান্তিদায়ক, নিরাপদ। যেখানে তাদের রিজিক আসত প্রত্যেকটি স্থান থেকে। অতঃপর তারা আল্লাহর এই নিয়ামতকে অস্বীকার করল। সুতরাং আল্লøাহ তায়ালা তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ তাদেরকে ভয় এবং ক্ষুধার পোশাক আস্বাদন করালেন’ (সূরা নাহল-১১২)।
কুফরি কথা বা কাজ
১. কেউ গোনাহকে বিদ্রƒপবশত হালাল জেনে করলে : ‘যখন তুমি দেখো আমার আয়াত নিয়ে তারা উপহাসপূর্ণ আলোচনা করছে তখন তাদের থেকে সরে পড়ো, যে পর্যন্ত তারা অন্য বিষয়ের আলোচনায় প্রবৃত্ত না হয়। আর যখন শয়তান তোমাকে (আল্লøাহর এই নসিহত) ভুলিয়ে দেয় তখন স্মরণ হয়ে গেলেই জালিম সম্প্রদায়ের সাথে আর বসবে না’ (সূরা আনআম-৬৮)।
‘কেউ যদি গোনাহের কাজ আরম্ভ করে নিজের সঙ্গী-সাথীদের বলে, এসো! আমরা আমোদ ফুর্তি করি। তাহলে এ কথা কুফরি কালাম বলে গণ্য হবে’ (ফতোয়া আলমগিরি, দ্বিতীয় খণ্ড, ২৭৩ পৃষ্ঠা)
‘উল্লাস ও গানের ধ্বনি হৃদয়ে কপটতা বৃদ্ধি করে যেমন পানি গাছপালা বৃদ্ধি করে। আমি বললাম, আল-বাজাজিয়ায় বিনোদন পার্কের শব্দ শোনা যেত বেত মারার মতো এবং এটি হারাম। কেননা, রাসূল সা: ইরশাদ ফরমান, ‘গানবাদ্যের আওয়াজ শোনা পাপ, সেসব বৈঠকে বসা ফাসেকি ও তা থেকে স্বাদ উপভোগ, উল্লাস এবং আনন্দ করা কুফরি’ (ফতোয়ায়ে শামি, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৪৮-৩৪৯)।
২. ঠাট্টা ও কৌতুকচ্ছলে কুরআনের কোনো আয়াত উল্লেখ করলে : ‘কেউ যদি কোনো ব্যক্তিকে বলে, তুমি তো ‘কুলহু আল্লাহ’-এর খাল ছিলে ফেলেছ অথবা ‘আলাম নাশরাহ’-এর আঁচল টেনে ধরেছ অথবা কোনো অসুস্থ ব্যক্তির সামনে যে সূরা ইয়াসিন তিলাওয়াত করছে তাকে কেউ বলল মৃত ব্যক্তির মুখের ওপর সূরা ইয়াসিন রাখবে না অথবা এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে বলল, হে ‘ইন্না আ‘তয়নাকা’ সূরার চেয়েও অধিক বেটে ব্যক্তি, অথবা কুরআন তিলাওয়াতকারী কোনো ব্যক্তি যার একটি শব্দ মনে আসছে না তাকে উদ্দেশ করে অপর ব্যক্তি বলল ওয়ালতাফাতিস সাকু বিসাকি অথবা পেয়ালা ভরে কোনো ব্যক্তির নিকট এনে বলল ‘ওয়া কা-ছান দিহাকা’ ঠাট্টাচ্ছলে, ‘ফা কানাত ছাসারা’ অথবা পরিমাপের কৌতুকের সাথে বলল ‘ওয়া ইজা কালুহুম আওয়াজানুহুম ইয়াখছিরুন’ অথবা কেউ অপর কোনো ব্যক্তিকে বলল তুমি ‘আলাম নাশরাহ’-এর পাগড়ি বেঁধেছ অর্থাৎ তুমি নিজ ইলমকে জাহির করেছ অথবা কোনো জায়গায় লোকদের জমায়েত করে বলল ‘ফাজআলনাহুম জামআ’ বা বলল ‘ওয়া হাশারনাহুম ফালা নুগাদিরহুম’ অথবা এক ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তিকে বলল ‘ওয়ান নাজিয়াতি নাজআ’-এর ‘আইন’কে যবরের সাথে পড়ো না পেশের সাথে পড়ো?
উদ্দেশ্য হলো তিলাওয়াতকারীকে ভর্ৎসনা করা অথবা কেউ কোনো ব্যক্তিকে বলল তুমি পড়ো আমি তোমাকে গালমন্দ করব, কেননা আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন ‘কাল্লা বাল রা-না’ অথবা কাউকে জামাতের সাথে সালাত আদায়ের জন্য ডাকায় বলল আমি একাই সালাত আদাই করব কেননা আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন ‘ইন্নাস সালাতা’ অথবা কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে বলল ‘তাফশিলিহি ইয়াজুযু’ (হীনবল হওয়া জায়েজ) কেননা এটি বাতাসের সাথে উড়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ ‘ওয়ালা তানাজায়ু ফাতাফশালু’ তাহলে উপরোক্ত অবস্থানগুলোকে সব ব্যক্তি কাফির বলে গণ্য হবে (ফতোয়া আলমগিরি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৬৭)।
৩. কিয়ামতকে নিয়ে বিদ্রƒপ করলে :‘ঋণদাতা ঋণ গ্রহীতাকে বলল- যদি এখন না দাও কিয়ামতে অবশ্যই দিতে হবে। এ কথা শুনে গ্রহীতা বলল- কিয়ামত কী হবে? তাচ্ছিল্যের নিয়তে বললে কুফরি হবে। মজলুম ব্যক্তি জালিমকে বলল- ঠিক আছে কিয়ামত তো আছেই, এ কথা শুনে জালিম বলল- (তাচ্ছিল্যের সাথে) কিয়ামতে অমুক গাধা হবে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে’ (ফতোয়া আলমগিরি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৭৪)।
৪. বংশের প্রতি কটাক্ষ ও কারো মৃত্যুর পর বিলাপ করা : ‘হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, দুটো স্বভাব মানুষের মাঝে রয়েছে, যা কুফর বলে গণ্য। বংশের প্রতি কটাক্ষ করা এবং মৃত ব্যক্তির জন্য উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করা’ (সহিহ মুসলিম-১৩০)।
৫. আপন পিতার সম্পর্ক ছিন্নকারী : ‘হজরত আবু হুরায়রা রা: সূত্রে নবী সা: হতে বর্ণিত- তিনি বলেছেন, তোমরা তোমাদের পিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না (অস্বীকার করো না)। কারণ যে লোক নিজের পিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় (পিতাকে অস্বীকার করে) অতঃপর সে কুফরি করল’ (বুখারি-৬৭৬৮, মুসলিম-১২১)।
৬. বিদ্রƒপ করে সগিরা গোনাহ করলে : ‘এক ব্যক্তি সগিরা গোনাহ করায় তাকে বলা হলো তুমি এই গোনাহ থেকে আল্লাহর কাছে তওবা করো। সে বলল, আমি কী করেছি যে তওবা করব? অথবা বলল, আমার এই সামান্য কাজের জন্য তওবা? তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে’ (মুহিত, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৭৭, ফতোয়া হিন্দিয়া, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৭৩)।
৭. কোনো পয়গম্বরকে অস্বীকার, সুন্নতকে অবজ্ঞাভরে অপছন্দ করলে : ‘কেউ যদি এক নবীগণকে স্বীকার না করে অথবা নবী রাসূলগণের কোনো একটি সুন্নতকে অপছন্দ করে তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে’ (ফতোয়া আলমগিরি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৬৩)।
‘মারিফাতের পর নবীদের প্রতি ইমান থাকা আবশ্যক। একজন নবী মানে মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বার্তাবাহক। তাঁর আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা এবং তিনি মহান আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে যা বলেছেন তার প্রতি তাঁর বিশ্বাস রাখা। হজরত মুহাম্মদ সা:-এর প্রতি বিশ্বাস রাখা। তাই যদি কেউ বিশ্বাস করে থাকে তিনি একজন রাসূল তাহলে অবশ্যই আমাদের উচিত রাসূল সা: এবং নবী-রাসূলদের মধ্যে তাঁকে সর্বশষ বলে বিশ্বাস করা। আর যে তাঁকে শেষ নবী বলে বিশ্বাস করেনি সে কখনো ঈমানদার হতে পারে না। যে কেউ নবীগণের কোনো কিছু সম্পর্কে স্বীকার করে না অথবা সে রাসূলগণের কোনো একটি সুন্নতকে অপছন্দ বা অসন্তুষ্ট প্রকাশ করে তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে’ (মাজমুউল আনহুর শরহে মুলতাকাল আবহার প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৯১)।
৮. খঞ্জনী, বাঁশি, হারমোনিয়াম ও গ্রামোফোন বাজিয়ে কুরআন তিলাওয়াত বা এসব কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করা : আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘কিতাবে তোমাদের নিকট তিনি নাজিল করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর আয়াতের প্রতি কুফরি হচ্ছে এবং তার প্রতি ঠাট্টা করা হচ্ছে, তখন তাদের নিকট বসো না, যে পর্যন্ত তারা অন্য আলোচনায় লিপ্ত না হয়, নচেৎ তোমরাও তাদের মতো হয়ে যাবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুনাফিক ও কাফিরদের সবাইকেই জাহান্নামে একত্র করবেন’ (সূরা নিসা-১৪০)।
ঠাট্টা করে বলাকে আমরা মোটেই আমলে নিই না। অথচ পবিত্র কুরআনের আয়াত বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে, গানের আসরে বা বাঁশি, হারমোনিয়াম বাজিয়ে বাজিয়ে নেচে নেচে সুর দিচ্ছে। আবার কেউ আছেন বাঁশি, হারমোনিয়াম না থাকা সত্ত্বেও সেসব সুরের তালে পবিত্র কালামে পাক তিলাওয়াত করছেন, যা অবশ্যই কুফরির পর্যায়ে পড়ে। যারা এসব বৈঠকে বসবে তারাও গোনাহগার হিসেবে গণ্য হবে। ফতোয়ার ভাষায়- ‘কেউ যদি বাদ্যযন্ত্র ও বাশুরীর সুরে কুরআন তিলাওয়াত করে তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে’ (ফতোয়া হিন্দিয়া, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৬৭)।
‘কুফরি কাজ হচ্ছে- প্রতিমা, সূর্য, চন্দ্রকে সিজদা করা, কুরআনুল কারিমকে ময়লায় নিক্ষেপ করা, জাদু; যে জাদুতে সূর্যের পূজা জড়িয়ে আছে, প্রতিমার জন্য পশু জবাই করা, কটাক্ষ করা আল্লাহ তায়ালার নামসমূহের নামে, অথবা তার আদেশে বা তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, অথবা বাদ্যযন্ত্র ও বাশুরীর সুরে কুরআন তিলাওয়াত করা’ (কাফিয়াতুল আখয়ার ফি হাল্লে গায়েতিল ইখতিছার, পৃষ্ঠা-৪৯৪)।
‘কুরআনের কোনো আয়াতকে ঠাট্টা বিদ্রƒপ করলে কাফির হবে কি-না তা নিয়ে মতভেদ আছে। সহিহ মত হচ্ছে- লোকটি যদি আলিম না হয় তাহলে কাফির হয়ে যাবে, আলিম হলে শপথের কাফফারা আদায় করতে হবে, আর বাদ্যযন্ত্র ও বাশুরীর সুরে কুরআন তিলাওয়াত করা হলে কুফরি হবে’ (আল বাহরুর রায়েক, পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩১)। (আগামীকাল সমাপ্য)
লেখক : আলেম ও গবেষক
Leave a Reply