সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইতিহাসে এটি রেকর্ড যে, একই সাথে ৪৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিতে যাচ্ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১২ মে অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ৪০ হাজার ৮৬২ জন। তাদের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ ১২ জুন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তিন ধাপে পরীক্ষা নেয়া হবে। জানানো হয়েছে, প্রার্থীদের রোল নম্বর, আসনবিন্যাস, প্রশ্নপত্র পাঠানো ও মুদ্রণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল প্রস্তুতসহ সব কাজ সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করেছে যেন, এ নিয়োগ নিয়ে দালাল বা প্রতারক চক্রের প্রলোভনে কোনো ধরনের অর্থ লেনদেন কেউ না করেন।
অনেক সরকারি বিজ্ঞপ্তি বা নোটিশ বেশ কৌতুককর! যেমনটি এখন সরকারি প্রায় সব বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফটকেই লেখা থাকে আমি এবং আমার প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত। এটি যে কত বড় মিথ্যাচার, এদেশের নাগরিকরা তা ভালো করেই জানেন। বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৮০ হাজার ৩৯৭টি।
এর মধ্য সরকারি ৩৭ হাজার ৬৭২টি, বেসরকারি ৪২ হাজার ৭২৫টি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন চার লাখ। আমার কাছে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে এর মধ্য ২০ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা ঘুষ ছাড়া চাকরিতে নিয়োগ হতে পেরেছেন কি না! দেশের প্রায় সবখানে শুধু ঘুষের কথা শুনি। এই ঘুষ কারা নেন? অদৃশ্য কোন শক্তি এসে এই ঘুষ নিচ্ছেন? মঙ্গলগ্রহ বা চাঁদের দেশের কেউ এসে এই ঘুষ নিয়ে যাচ্ছেন? সরকারি হোমরা চোমরা তথাকথিত রাজনীতিবিদ, তথাকথিত আইন প্রণেতা, সরকারি কর্মচারীরাই এই ঘুষ নিচ্ছেন। এখানে বিশাল ঘুষের খেলা। বড় বড় নিয়োগে তাদের বিশেষ পকেটগুলোতে শত শত কোটি টাকা ঢুকে যায়। দেশের নাগরিকরা এটি খুব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছেন যে, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ মানেই লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হবে।
বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদ খুব লোভনীয় হয়ে উঠেছে। এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনেক বেতন। আরো কত সুযোগ-সুবিধা! কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে এই বিদ্যালয়ে কেউ কেউ আছেন শিক্ষকতা পেশাকে মহৎ পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বহু ট্রাজেডি পার করে বৈধভাবেই নিয়োগ পেয়েছেন। একাডেমিক শিক্ষাগত ডিগ্রিও হাই ক্লাসের। তাদের জন্য এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা মহা যন্ত্রণাকর হয়ে উঠেছে। কারণ অযোগ্য, কম একাডেমিক শিক্ষিত, অশ্লীল চরিত্রের অনেকেই ঘুষ দিয়ে শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছেন। তারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে বাজে আড্ডাখানায় পরিণত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও কয়েক বছর আগে ভাইরাল হয়েছিল। সেখানে দেখা গেছে, দুই জা একই বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।
তাদের পারিবারিক কোনো বিষয় নিয়ে তারা বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সামনেই মারামারি করছেন। একজন আরেকজনের চুল টেনে মারছেন। এই ভিডিও দেখে লজ্জায় মুখ লুকাতে ইচ্ছে করেছে। ভাবতেই লজ্জা লেগেছে, এত নিম্ন মানের রুচিহীন নারীও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হয়েছেন? ঢাকার পূর্ব মধ্যবাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন মাকে কিভাবে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে সেটি বিশ্ববাসী মিডিয়ায় দেখেছে। রেনু নামের সেই মাকে ছেলেধরা বলে বখাটেরা পিটিয়ে হত্যা করে ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সামনেই। আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেমন ভীতু চরিত্রের সেটিও এখানে প্রমাণিত। ওই শিক্ষকরা ইচ্ছা করলেই রেনু নামের মাকে বাঁচাতে পারতেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকা শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে পারেন না। শিশুদের তারা কি শেখাবেন! ঘুষ দিয়ে যারা শিক্ষক হয়েছেন তারা শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। এই শিক্ষকরা শিশুদের নৈতিকতা কি শেখাবেন! নিজেরাই অনৈতিকভাবে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে শিক্ষক হয়েছেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেশির ভাগই নারী শিক্ষক। এমনিতেই আমাদের সমাজে একটি কথা প্রচলন আছে, নারীরা যতই শিক্ষিত হোক কয়েকজন নারী একসাথে থাকতে পারেন না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এই নারী শিক্ষিকারা একে অপরের বিরুদ্ধে লিপ্ত। এখানেও সরকারি বড় বড় অফিসের মত, বেসরকারি করপোরেট অফিসের কর্মচারীদের মতো গ্রুপিং চলে।
বাড়িঘরের ঝগড়া শিক্ষার্থীদের সামনেই চালাতে থাকেন। কোনো কোনো শিক্ষিকা শিক্ষার্থীদের দিয়ে চুলে বিলি দেয়ান। কেউ বাতাস দেয়ান। স্কুলের ওয়াশরুম নোংরা থাকে। দেয়াল থাকে বিশ্রী। ফ্যান থাকে নষ্ট। অনেক স্কুলের হেড মিস্ট্রেস, সভাপতি স্কুলের নামে বিভিন্ন বিল উঠিয়ে নিজেরা মেরে দেন। স্কুলের জন্য কাজ করেন না। একেকটি স্কুলে বহু ধরনের বিল আসে। অনেক স্কুলের হেড মিস্ট্রেস সহকারী শিক্ষক শিক্ষিকাদের ইনসাফ ভিত্তিক ট্রেনিংয়ে পাঠান না। নিজেই ট্রেনিং করেন আর বিভিন্ন সুবিধা নেন।
সেসব ট্রেনিং পরে স্কুলে কোনো কাজে লাগে না। হেড মিস্ট্রেস ইচ্ছে করলে সহকারী শিক্ষিকাদের বিভিন্ন ভাগে ট্রেনিংয়ে পাঠাতে পারেন। কিন্তু তারা সেটি না করে নিজের পছন্দের, নিজের তৈরি করা চাটুকার গ্রæপের শিক্ষিকাদের পাঠান। চাটুকারীরা এসব স্কুলেও অনেক শক্তিশালী। যাদেরকে দুর্বল মনে করে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় অতিরিক্ত ক্লাস এবং অন্যান্য কাজ। যদি কোনো শিক্ষিকার হাসবেন্ড সমাজের হোমরা চোমরা প্রভাবশালী ইত্যাদি থাকে তাহলে সেই শিক্ষিকাদের চাপে রাখেন না। তাদের ঢিলেঢালাভাবে চলার সুযোগ দেন।
অনেক স্কুলের সভাপতি থাকেন সমাজের দুষ্ট শ্রেণীর কেউ। স্কুলের সুন্দরী শিক্ষিকাদের ওপর থাকে তাদের কুনজর। জেলা, উপজেলা ও থানার দায়িত্বশীল প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বেশির ভাগ বড় রোডগুলোর পাশের স্কুলগুলো পরিদর্শন করেন। কিন্তু গ্রামের বা মহল্লার ভেতরের স্কুলগুলো ঠিকমতো পরিদর্শন করেন না। কোটি কোটি বেকারের দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদের চাকরির এখন অনেক মূল্য। কোনো কোনো মাদরাসার উচ্চ শিক্ষিত হুজুর শিক্ষক ইমাম সাহেবও তাদের স্ত্রীদের ঘুষ দিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বানান।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় (লিখিত) উত্তীর্ণ হয়েছেন এমন এক যুবক ক’দিন আগে এসে বললেন, ভাইভাটা কিছুই না। ঘুষ না দিলে চাকরি হবে না। তবে আমি ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকব না। তিনি এটাও বললেন, আমাদের জেলা প্রশাসক সৎ মানুষ। ডিসি ম্যাডাম অনেক সুনাম অর্জনকারী। তিনি যদি নিজে সব পরিচালনা করতে পারেন তাহলে হয়তো ঘুষের লেনদেন হবে না।
সরকারি চাকরিতে ঘুষ না দিয়ে খুব অল্প সংখ্যক ব্যক্তি যোগ দিতে পারেন। সেটি মিডিয়াতে আবার বেশ প্রচার পায়। যেমনটি বীমা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে হয়। টাকা নেয়া হয় লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষের কাছ থেকে। হাত-পা কাটে অল্প লোকের। সেটাই বীমা ইন্স্যুরেন্সওয়ালারা বেশ ঘটা করে প্রকাশ করেন।
ছোটবেলা শুনতাম আদালতে সাক্ষী হিসেবে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে গ্রহণ করে না। এর কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিশু স্বভাবের হন। এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ তাদের দীর্ঘ সময় শিশুদের নিয়ে প্র্যাকটিসে থাকতে হয়। ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়ার উন্নত অনেক দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেয়া হয়।
আমাদের দেশে কিছুদিন আগে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এনেছে। কিন্তু মৌলিক জায়গায় উন্নতি না করে শ্রেণী উন্নীত করে লাভ নেই। যোগ্য ব্যক্তিরা যারা প্রকৃতভাবে শিক্ষকতা পেশাকে পছন্দ করেন। দেশকে ভালোবাসেন। যাদের নৈতিকতা আছে তাদের শিক্ষক পদে নিয়োগ করার মসৃণ পথ তৈরি করা দরকার। যোগ্যরাই যাতে শিক্ষক হতে পারেন এবং সেটি ঘুষ ছাড়া, তাহলে দেশ অনেক উন্নত হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। বিশ্ব ব্যাংক থেকেও অর্থ আসে। কিন্তু কেন দরিদ্র ছাড়া মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় না সেটি সরকারের ভেবে দেখা উচিত।
Leave a Reply