একটি গাড়িকে একটি মানুষের সাথে যদি তুলনা করা হয় তাহলে দেখব যে, মানুষের যেমন প্রধান অঙ্গ বলতে তার হার্টকে বোঝায়, তেমনি একটি গাড়ির ইঞ্জিনকে যদি হার্টের সাথে তুলনা করি তাহলে দেখব, মানুষের হার্ট যদি ভালো থাকে একজন মানুষ সুস্থ থাকে, তেমনি গাড়ির ইঞ্জিনও যদি সুস্থ থাকে তাহলে গাড়িও সুস্থ থাকবে। গাড়ির ইঞ্জিন ভালো রাখার জন্য অবশ্যই ভালো মানের ইঞ্জিন অয়েল আমাদের ব্যবহার করতে হবে। ভালো ইঞ্জিন অয়েল চেনার জন্য আমাদের অবশ্যই ইঞ্জিন অয়েল সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকা আবশ্যক।
আমাদের প্রথমে জানতে হবে ইঞ্জিন অয়েল আসলে কী? মূলত অন্তর্দহন ইঞ্জিন থেকে তাপ উৎপাদনের মাধ্যমে গাড়ির ইঞ্জিন পরিচালিত হয় এবং সেই ইঞ্জিনের মধ্যে যে লুব্রিকেন্ট জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা হয় সেটিই হচ্ছে মূলত ইঞ্জিন অয়েল। আমরা মূলত বাইক বা গাড়ির ইঞ্জিনের জন্য তিন ধরনের অয়েল আমাদের দোকানগুলোতে পেয়ে থাকি; একটি হচ্ছে মিনারেল অয়েল, এটি সরাসরি ভ‚গর্ভ থেকে আসে। এ ছাড়া পরবর্তী সময়ে মিনারেল অয়েল পরীক্ষাগারে পরিশোধন করে যেটা প্রক্রিয়াজাত করা হয় সেটি হচ্ছে সিনথেটিক অয়েল। এ ছাড়া মিনারেল এবং সিনথেটিক অয়েল দু’টি মিলিয়ে যে অয়েল প্রক্রিয়াজাত করা হয় সেটি হলো সেমি সিনথেটিক অয়েল এবং এই অয়েলটি আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ইঞ্জিন অয়েলের প্যাকেটের দুই ধরনের গ্রেড দেখা যায়। একটি হচ্ছে মাল্টিগ্রেড, আরেকটি হচ্ছে মনোগ্রেড। মাল্টিগ্রেড হচ্ছে যেখানে আমরা দুই ধরনের সংখ্যা দেখতে পাই 5W-৩০; মনো গ্রেড হচ্ছে যেখানে একটি মাত্র সংখ্যা থাকে যেমন 10W। আমাদের দক্ষিণ এশিয়া, এই এলাকাগুলো যেহেতু নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল এ জন্য খুব বেশি শীত পড়ে না আবার খুব বেশি গরমও পড়ে না। বিশেষ করে শীতপ্রধান দেশগুলোতে মনোগ্রেডের ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে মাল্টিগ্রেডের ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহৃত হয়। মাল্টিগ্রেডের ইঞ্জিনগুলোতে প্রথমে যে সংখ্যাটা থাকে যেমন 5W/ 10W/0W এই সংখ্যাগুলোর সাথে ড লিখা থাকে; আমরা সাধারণত এটাকে মনে করে থাকি ড দিয়ে ওজন বোঝায়; কিন্তু এটা আসলে ডরহঃবৎ বোঝাতে ব্যবহৃত হয় এবং এর দ্বারা ইঞ্জিন অয়েলের ভিস্কোসিটি এবং ডেনসিটি বোঝাতে সাহায্য করে। ইঞ্জিন অয়েল তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে ব্যবহার করার জন্য রিকমেন্ড করা হয়।
এখন যে জিনিসটা জানব সেটা হচ্ছে, ইঞ্জিন অয়েল একটি ইঞ্জিনের মধ্যে পাঁচ ধরনের কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়, যেমন- এটি আমাদের ইঞ্জিন সিলিন্ডারের মধ্যে ঘর্ষণ থেকে রক্ষা করে, পিচ্ছিলতা তৈরি করে, ইঞ্জিন অয়েলটা যখন ইঞ্জিনের মধ্যে সচল হয় তখন এর এখানে যে অতিরিক্ত তাপ উৎপন্ন হয় সেটি থেকে তাপ কমাতে সাহায্য করে, ইঞ্জিন অয়েল ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং ডিটারজেন্ট বা পরিষ্কারকারক/ফ্লাশিং এজেন্ট হিসেবে ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহৃত হয়।
পেট্রল ইঞ্জিনে সর্বোচ্চ ১৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা উৎপন্ন হয়, এ ছাড়া ডিজেল ইঞ্জিনকে যেহেতু হাইপ্রেসার ইঞ্জিন বলে, এখানে ৩২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত তাপমাত্রা উৎপন্ন হয়। ইঞ্জিনের এই তাপমাত্রা থেকে ইঞ্জিনের ক্ষতি যেন না হয় সে জন্য অবশ্যই ভালো মানের ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করা উচিত। এ ছাড়া এই ইঞ্জিনের তাপমাত্রা ও এখানে ঘর্ষণের ফলে যে ক্ষয় হয় এর ফলে কিছু কণা জমে, এই কণাগুলোই আসলে ইঞ্জিন অয়েলের ভেতরে চলার ফলে ইঞ্জিন অয়েলটাকে কালো দেখায় এবং এই ইঞ্জিন অয়েলের ময়লা পরিষ্কারের জন্য আবার ভালো মানের অয়েল ফিল্টার প্রয়োজন যেটা থেকে ইঞ্জিন অয়েলের জমাকৃত ময়লা ফিল্টারের মাধ্যমে পরিষ্কার হয়। ইঞ্জিন যখন সচল থাকে তখন ইঞ্জিনের মধ্যে ইঞ্জিন অয়েল ঘুরতে থাকে এবং ইঞ্জিন যখন বন্ধ করা হয় তখন অয়েল চেম্বারে এসে অয়েল জমা হয়, ইঞ্জিন অয়েলের সাথে সাথে ইঞ্জিনের যে ময়লাগুলো থাকে সেগুলো নিচে এসে জমা হয়। ভালো অয়েল ফিল্টার সুন্দরভাবে ফিল্টারিং করে এ জন্য আমাদের উচিত অয়েল ফিল্টারের দিকে গুরুত্ব দেয়া। এ জন্য সবসময় ভালো মানের অয়েল ফিল্টার ব্যবহার করা উচিত। আরেকটি বিষয়; গাড়ি যখন স্টার্ট করা হয় এ জন্য ইঞ্জিন যাতে ভালোভাবে গরম হয় সে জন্য কিছুক্ষণ স্টার্ট করে রাখা। স্টার্ট করার পরপরই গাড়ি ‘রান’ করা উচিত নয়, কারণ গাড়ি স্টার্ট করার ফলে গাড়ির ইঞ্জিন অয়েল ইঞ্জিনে সবদিকে সঞ্চালন হওয়ার যথেষ্ট সময় পায়। আমাদের দেশে যেহেতু প্রচুর পরিমাণ বালু বাইরে, এ জন্য তিন হাজার কিলোমিটার আগে সে অনুযায়ী ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তন করে নেয়া তবে সিনথেটিক অয়েলের ক্ষেত্রে আপনি আরো কিলোমিটার বেশি চালাতে পারবেন।
ভালো মানের ইঞ্জিন অয়েল কেনার জন্য এই ইঞ্জিন অয়েল সংশ্লিষ্ট আরো কয়েকটি বিষয় আমাদের সবারই জানা থাকা উচিত। এ ক্ষেত্রে প্রথমে আপনাদের বলব যে, ইঞ্জিন অয়েলের স্ট্যান্ডার্ড মাপার জন্য আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট অচও কোম্পানি এবং এর সাথে আন্তর্জাতিক লুব্রিকেন্ট স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন (ওখঝঅঈ) কাজ করে। এর মাধ্যমে ইঞ্জিন অয়েলের স্ট্যান্ডার্ড নির্ণয় করা ও অনুমোদন দেয়া হয়। প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে। এটা আপনার লক্ষ করলে দেখতে পারবেন। আরেকটি বিষয়- অরিজিনাল অয়েল একটু ঝাঁজালো ও গন্ধযুক্ত হবে। তবে অরিজিনাল অয়েল ঢালার সময় কয়েকবার হাতে নিয়ে অভিজ্ঞতা নিতে হবে।
এতক্ষণ আপনাদের ভালো ইঞ্জিন অয়েল চেনার এবং এটা ব্যবহার করলে কী সুবিধা, এর কথা বললাম। কিন্তু যদি নিম্নমানের ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করেন তাহলে ইঞ্জিনের কী কী ক্ষতি হতে পারে সেটিও আমাদের জানা উচিত। প্রথমে বলব আমাদের দেশে যেহেতু ব্যবসায়ীরা মুনাফালোভী এ জন্য বিভিন্ন নিম্নমানের ইঞ্জিন অয়েল তাদের দোকানগুলোতে রাখেন এবং ড্রাইভারের মাধ্যমে যারা গাড়ি মেইনটেন্যান্স করেন তাদের কাছে এটা বিক্রি করেন। এতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের প্রিয় গাড়িটির ইঞ্জিন খুব দ্রুত বিকল হয়ে যাচ্ছে এবং ইঞ্জিনের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
নিম্নমানের অয়েল ব্যবহার করলে যেটা প্রাথমিক পর্যায়ে আপনার সমস্যা হবে সেটি হচ্ছে- আপনার গাড়ির মাইলেজ কম পাবেন এবং ইঞ্জিনের এফিসিয়েন্সি, এক্সেলারেশন কমে যাবে এবং আপনার মনে হবে যে, গাড়িটি একটু ভার ভার হয়ে আছে। উপরে যে পাঁচটি গুণের কথা বলেছিলাম একটি ভালো মানের ইঞ্জিন অয়েল সেটির বিপরীত কাজ করবে যখন আপনি নিম্নমানের ইঞ্জিন অয়েলের তেল ঢালবেন। এ জন্য আপনাকে লক্ষ রাখতে হবে অথেন্টিক এবং রিলায়েবল পার্টস শপ থেকে সংগ্রহ করার প্রতি এবং গাড়ি ব্যবহারকারীরা, আপনাদের আরেকটি ছোট পরামর্শ দেবো সেটি হচ্ছে- আপনি যে ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করবেন এটার যে জার বা ক্যান এটি নষ্ট করে ফেলার চেষ্টা করবেন। কখনো চেষ্টা করবেন না যে, এটা ভালো অবস্থায় কারো কাছে বিক্রি করা, কারণ এটার মাধ্যমে আপনি আমাদের দেশের অসাধু চক্র তারা নিম্নমানের ইঞ্জিন অয়েল তৈরি করে আবার ভালো মানের জারে ঢেলে দিয়ে এটা বিক্রি করছে, আপনি যদি এটা নষ্ট করে ফেলেন তখন তারা এটার কস্ট বেড়ে যাবে, এ জন্য নিম্নমানের থেকে কিছুটা হলেও তো আমরা মুক্তি পাবো। আপনার এবং আপনার প্রিয় গাড়ির সুস্থতা কামনা করছি, সাবধানে ও নিরাপদে গাড়ি চালান সেই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
লেখক : ইঞ্জিনিয়ার অটোমোবাইল এক্সপার্ট, প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী
Leave a Reply