দেশে অব্যাহত অভিযানে নিবন্ধন না থাকাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৫০০ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়গনোস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সারাদেশে হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনা এবং চিকিৎসার মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ এবার কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের এই অভিযানে ছোট-বড় সব ধরনের হাসপাতালেই নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অবৈধ হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক অভিযানের সময় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে পদ্মা জেনারেল হাসপাতালে অভিযান হতে পারে – এমন খবরে সেখানে সদ্যজাত সন্তানসহ এক নারীকে অপারেশেন টেবিলে ফেলে রেখে পালিয়ে যান ক্লিনিকটির ডাক্তার-নার্সসহ সবাই।
ঘটনাটি ঘটে রোববার ২৯ মে এবং এ ঘটনা ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে।
পরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অভিযানে নিবন্ধন এবং এমনকি সার্বক্ষণিক কোনো ডাক্তার না থাকাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে ক্লিনিকটি সিলগালা করে দেয়া হয়।
ক্লিনিকটিতে ওই ঘটনার শিকার নারীকে সদ্যজাত সন্তানসহ উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য কাছেই একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
তার স্বামী তানভীর হাসান বলেন, ওই ক্লিনিকটির দালারের খপ্পরে পড়ে তারা সেখানে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন।
তিনি জানান, আমি অন্য জায়গায় ছিলাম। আমার শাশুড়ি আমার স্ত্রীকে এই ক্লিনিকে নিয়ে আসে। এক মহিলা দালাল আমার শাশুড়িকে ভুল বুঝিয়ে এখানে নিয়ে আসে। তারপর ক্লিনিকে নিয়ে বলেছে যে, ১৮ হাজার টাকা লাগবে। আমরা ১২ হাজার টাকা দিলে দুই মিনিটের মধ্যে সিজার করার জন্য ভেতরে নিয়ে গেল।
তানভীর হাসান আরো জানান, তার স্ত্রীকে যখন অপারেশন টেবিলে নেয়া হয়, তখন সেখানে সাংবাদিক এবং অভিযানের লোকজন আসছে বলে খবর আসে।
সে সময় মুহূর্তেই সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানকে হাসানের হাতে দিয়ে এবং তার স্ত্রীকে অপারেশন কক্ষের ভেতরে রেখেই সেই কক্ষে তালা লাগিয়ে ক্লিনিকের ডাক্তার-নার্সসহ সবাই পালিয়ে যায়।
তিনি আরো বলেন, পরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অভিযানের লোকজন এসে তালা ভেঙে তার স্ত্রীকে পাশে একটি সরকারি হাসপাতালে পাঠায়।
স্থানীয় লোকজন জানান, ওই ক্লিনিকে অভিযানের পর থেকে স্থানীয় বেশির ভাগই ক্লিনিকই বন্ধ রয়েছে।
নাগরিকের স্বাস্থ্য অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী এবং বারডেম হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডা: রশিদ-ই মাহবুব বলেছেন, সারাদেশেই সরকারি চিকিৎসা সেবায় ঘাটতির সুযোগ নিয়ে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কোনো নিয়ম না মেনে শত শত হাসপাতাল ও ক্লিনিক গড়ে উঠেছে।
সেজন্য চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা চরম এক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি উল্লেখ করেন, সরকারিভাবে চিকিৎসাসেবা যেহেতু পর্যাপ্ত নয়, সুতরাং চাহিদা আছে। এখন এই চাহিদার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন জায়গায় বেসরকারি পর্যায়ে হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলো গড়ে উঠছে।
বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম শর্তই হচ্ছে এর নিবন্ধন করতে হবে।
কিন্তু নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছ্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে ডা: রশিদ-ই মাহবুবের।
এই নিবন্ধন প্রক্রিয়া কিন্তু প্রয়োজনের ভিত্তিতে নয়। যে যেভাবে পারে নিবন্ধনটা করিয়ে নিয়ে তা চালিয়ে দেয়।
ডা: মাহবুব আরো বলেন, জনগণ স্বাভাবিকভাবে তাদের চিকিৎসাসেবা পায় না বলে দালালচক্রের মাধ্যমে এসব স্থানে যায়।
ব্যক্তি মালিকানায় বা বেসরকারিভাবে পরিচালিত হাসপাতাল-ক্লিনিক বা ডায়গনোস্টিক সেন্টারগুলোতে সেবার মানসিকতার চেয়ে বড় হয়ে উঠছে মূলত ব্যবসায়িক চিন্তা – বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা।
তিনি বলেন, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই কিন্তু যখন যেটাতে লাভ সেটা ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠতে থাকে। সেটা হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার হতে পারে। সেখানে মান দেখার জন্য কর্তৃপক্ষের যে পরিমাণ জনবল দরকার, তার ঘাটতি আছে, এছাড়া মানুষেরও সচেতনতার অভাব আছে।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সব পর্যায়েই ব্যয় অনেক বেশি এবং আইসিইউতে কোনো রোগীকে যেতে হলে গুণতে হয় অনেক বেশি টাকা।
সেখানে অনেক সময় পুরো টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত লাশ বের করতে দেয়া হয় না, এমনকি রোগী সুস্থ হওয়ার পরেও আইসিইউ থেকে ছাড়া পায় না – এ ধরনের নানা অভিযোগ বিভিন্ন সময় ওঠে।
ঢাকায় বেসরকারি বড় এক হাসপাতালে এমনই এক পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন প্রায় ৭০ বছরের একজন নারী, যে অভিজ্ঞতার কথা জানান তার একজন আত্মীয় পরিচয় গোপন রাখার শর্তে।
তিনি বলেন, আমাদের রোগী আইসিইউতে ১২ দিন থাকার সময় মাঝে আমি পেমেন্টও করেছি। পরে আমরা রোগীকে যেদিন কেবিনে নিয়ে শিফট করতে গিয়েছিলাম, সেদিন আমরা পেমেন্টটা করিনি। কিন্তু হাসপাতাল ওই মুহূর্তে আমাদের বলতেছে যে, আইসিইউতে থাকার পুরো পেমেন্ট না করলে কেবিনে নেয়া যাবে না। আমরা বললাম, আমরা তো এই হাসপাতালেই থাকছি। আমাদের আইসিইউ-এর অল্প কিছু পেমেন্ট বাকি আছে। কিন্তু তারা তা মানেনি। যখন টাকা পুরো ক্লিয়ার করেছি, তারপর রোগীকে কেবিনে নিতে দিয়েছে।
চিকিৎসাসেবা নিয়ে অভিযোগের পাল্লা অনেক ভারী। চরম অব্যবস্থাপনা, মূলত ব্যবসায়িক চিন্তায় হাসপাতাল-ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করা – এসব অভিযোগ স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িতদেরই অনেকে তুলেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক কর্মকর্তা অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা বলেছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোর ব্যাপারে সরকারের নতুন কোনো উদ্যোগ নেই। সে কারণে স্বাস্থ্যখাত বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের দখলে চলে গেছে।
সরকারি খাতটাকে এখন আর উন্নত করার চেষ্টাই করা হচ্ছে না। বড় বড় হাসপাতাল হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সিস্টেম অনুযায়ী উন্নত করা হচ্ছে না।
অধ্যাপক তাহমিনা বলেন, সে কারণে প্রাইভেট খাতের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে মানুষ।
তিনি উল্লেখ করেন, জমিজমা বিক্রি করে হলেও মানুষ প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হচ্ছে।
অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা বলেন, সরকারি হাসপাতালে যারা যান, তাদেরকে সেবা পেতে অনেক রকম বাধা পার হতে হয়। যেমন দালালদের ব্যাপার আছে। তারপর টেস্ট বা ইনভেস্টিগেশন বাইরে থেকে করতে হচ্ছে – ইত্যাদি, এমন অনেক ব্যাপার আছে। সুতরাং বেসরকারি খাতকে ইগনোর করতে পারবেন না। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি দুটো খাতেই অনিয়মের চূড়ান্ত অবস্থা বিরাজ করছে।
বেসরকারি খাতে হাসপাতাল ক্লিনিকের সঠিক সংখ্যা কারো জানা নেই, যদিও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ডায়াগনোস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাইনুল আহসান জানিয়েছেন, ১৪ হাজারের মতো তাদের সমিতির তালিকাভুক্ত রয়েছে।
ডা: মাহবুব-ই-রশিদ বলেন, ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা এই বিশাল সংখ্যক বেসরকারি ক্লিনিকগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনার জন্য সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা যথাযথ নজরদারি কাঠামোই তৈরি হয়নি।
ডা: মাহবুব বলেন, উন্নত বিশ্বে তাদের আর্থিক সঙ্গতি আছে। কিন্তু আমাদের রেগুলেটরি কোনো মেকানিজম নেই এবং আর্থিক সঙ্গতিও নেই। ফলে সবকিছু মিলিয়ে এই জায়গাটা এখন যার-যার তার-তার।
তিনি উল্লেখ করেন, একদিকে আলাদা কোনো রেগুলেটরি মেকানিজম নেই, অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর বিষয়গুলো তদারকি করলেও নিবন্ধনের প্রক্রিয়া চালানো এবং নজরদারির জন্য তাদের প্রয়োজনীয় লোকবলও নেই।
সে কারণে তিনি মনে করেন, সার্বিকভাবে বিষয়গুলোর দিকে নজর না দিয়ে শুধু অভিযান চালিয়ে ভাল ফল পাওয়া যাবে না।
সপ্তাহ খানেক ধরে ঢাকাসহ সারা দেশে অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক ডায়গনোস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। এর আগেও বিভিন্ন সময় অভিযান চালানো হলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময় অভিযানে বন্ধ করে দেয়া অনেক হাসপাতাল ক্লিনিক পরে আবার চালু হয়েছে এবং আবার একই অনিয়ম করে চলেছে।
অনিয়ম বন্ধে কয়েক ধাপের পরিকল্পনা স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবির বলেছেন, এবার তারা কয়েক ধাপে অভিযানের পরিকল্পনা নিয়েছেন।
এই পরিকল্পনায় তারা বেসরকারি ও সরকারি – দুই খাতেরই হাসপাতালে অনিয়ম চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেবেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
একইসাথে বিভিন্ন সময় ব্যবস্থা নেয়ার পরেও সেভাবে ফল না পাওয়ার বিষয়টিও অধ্যাপক কবিরের বক্তব্যে উঠে এসেছে।
তিনি বলেন, আমাদের পারমিশন ছাড়া তো অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিক বা ডায়াগনোস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জায়গায়। এদের বিরুদ্ধে তো আমরা ক্রমাগত নোটিফিকেশন এবং অনেক সময় অনেক অফিশিয়াল অর্ডার দিয়েছি। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, এরপরেও তারা এ কাজগুলো করছে।
অধ্যাপক কবির বলেন, আমরা এখন যেটা করছি, সেটা হচ্ছে, যত হাসপাতাল ও ডায়গনোস্টিক সেন্টার লাইসেন্সবিহীন আছে, সেগুলোকে আগে ট্রেস করা বা চিহ্নিত করা।
তারা মনে করছেন, এগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হলে এগুলো তাদের মনিটরিংয়ের আওতায় চলে আসবে।
তিনি জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরে যেসব হাসপাতাল-ক্লিনিক নিবন্ধনের আবেদন করেছে, এখন দুই সপ্তাহের মধ্যে সেগুলো যাচাই করে আবেদনের নিষ্পত্তি করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের বক্তব্য হচ্ছে, বেসরকারি ও সরকারি – দুই খাতের হাসপাতালেই চিকিৎসার মান কী রকম, তা তারা চিহ্নিত করবেন।
তিনি বলেছেন, তাদের চিহ্নিত করার এই প্রক্রিয়ায় যেসব হাসপাতাল-ক্লিনিকে মান খারাপ পাওয়া যাবে, তাদের কিছুটা সময় দেয়া হবে মান উন্নত করতে।
কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মান উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া না হলে তারা তখন স্থায়ীভাবে সেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেবেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার তারা স্বাস্থ্যসেবা খাতে শৃঙ্খলা আনতে কয়েক ধাপের পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছেন এবং তাতে ফল পাওয়া যাবে।
কিন্তু সারা দেশে এ ধরনের হাজার হাজার ক্লিনিক ও ডায়গনোস্টিক সেন্টারকে নানান দুর্বলতা কাটিয়ে নিয়ম-নীতির আওতায় আনা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সন্দিহান স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িত অনেকেই।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply