ছাত্রলীগের নৃশংস হামলার শিকার হয়েছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হাইকোর্ট চত্বরে তারা কী ভয়াবহ মারধরের শিকার হয়েছেন সেই বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। এ হামলায় ছাত্রদলের নারীকর্মী ও হাইকোর্টের আইনজীবীরাও রেহাই পাননি। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন নারীকর্মীকে ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীরা চার দিক থেকে ঘিরে বেদম প্রহার করছেন। একপর্যায়ে ওই নারীকর্মী রাস্তায় পড়ে গিয়েও প্রহার থেকে রেহাই পাননি। তেমনি হাইকোর্ট চত্বরে রাস্তায় ফেলে এক ছাত্রদল কর্মীকে এমনভাবে পেটানো হয়েছে; যেন সাপ মারা হচ্ছে। এই নৃশংস দৃশ্য দেখে যে কেউ শিউরে উঠবেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিএনপি ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘রাজপথে ছাত্রদলের মাধ্যমে বিএনপির আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে’। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘জনগণের সমর্থন থাকলে কেউ গুণ্ডামিতে যায় না। আপনাদের পায়ের নিচে মাটি নেই। তাই ছাত্রলীগকে গুণ্ডামিতে নামিয়েছেন। এই ছাত্রলীগই বিশ্বজিৎ ও আবরারের মতো অনেক সম্ভাবনাময় তরুণকে হত্যা করেছে।’
হামলা সম্পর্কে ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আকতার হোসেন অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের হেলমেটবাহিনী রামদা, হকিস্টিক, রড, ক্রিকেট স্ট্যাম্পসহ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ছাত্রদলের শান্তিপূর্ণ মিছিলে আক্রমণ করেছে। অন্য দিকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেছেন, সহিংসতার উদ্দেশে ছাত্রদল যখনই ক্যাম্পাসে আসবে, তখনই তাদের প্রতিহত করা হবে। তার মতে, শিক্ষার পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থেই নাকি সেদিন ছাত্রদলকে প্রতিহত করা হয়েছে।
২০০৬ সালের পর থেকে ১৬ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। মইন-ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন জরুরি সরকার দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়ী করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। তিন মেয়াদ ধরেই রাষ্ট্রক্ষমতায় দলটি। ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন একটি নির্বাচনী প্রহসন হয়। আর ২০১৮ সালে ভোটের আগের রাতে ব্যালট দিয়ে বাক্স ভরার এক প্রহসন হয়। অনেকে একে ‘নিশিরাতের ভোট প্রহসন’ হিসেবে উল্লেখ করেন। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের পক্ষ থেকে আওয়াজ উঠেছে- এ সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে আছে। দেশে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। নির্বাচনব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আইনের শাসন নেই। সুশাসন শব্দটি উধাও হয়ে গেছে। দুর্নীতি, লুটপাট, গুম-হত্যায় দেশ বিপর্যস্ত। গণমাধ্যমবিষয়ক বৈশ্বিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে- গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় এক বছরে ১০ ধাপ নিচে নেমে গেছে দেশ। ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৬২ নম্বরে। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকেও।
বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিকে কিছু মানুষ বলছেন ব্যর্থ। দেশের অন্যতম বৃহৎ দলটি সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অরাজকতার বিরুদ্ধে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। জবাবে বিএনপি থেকে বলা হয়েছে, ১৬ বছর ধরে তাদের নেতাকর্মীরা সরকারের পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী এবং দলীয় ক্যাডার বাহিনীর টার্গেট। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপির ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর নামে মামলা। শত শত নেতাকর্মী হত্যা ও গুমের শিকার। নিজ ঘরে নেতাকর্মীরা ঘুমাতে পারেন না বহু বছর ধরে। পালিয়ে থাকতে হয়। তারা কতটা নির্যাতনের শিকার আদালত চত্বরে গেলেই চোখে পড়ে। বিএনপি থেকে আরো বলা হয়, এমন একটি পরিস্থিতিতেও দলের সতাকর্মীরা সভা-সমাবেশ করছেন, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছেন। কিন্তু সরকার তাতেও বাধা দিচ্ছে। ছাত্রদলের ওপর হামলা সর্বশেষ নজির।
সম্প্রতি বিএনপির উচ্চপর্যায়ের সভায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আন্দোলন জোরদারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে দলের ছাত্র, যুব ও অন্যান্য অঙ্গদল ঢেলে সাজানো হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপীই দলটিকে নানা কর্মসূচি পালন করতে দেখা যাচ্ছে। এসব কর্মসূচিতে লোকসমাগমও বাড়ছে। বিএনপি এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। সরকারকে পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে দলটির নেতৃত্ব। বর্তমান নির্বাচন কমিশনকেও মানে না বলে জানিয়েছে। নতুন নির্বাচন কমিশনের কোনো সভায় যোগ দেয়নি বিএনপি। দলটি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনেই কেবল নির্বাচনে যাবে। নিরপেক্ষ সরকার ও নির্বাচনের দাবিতে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে বিএনপি অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা শুরু করেছে। যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করছে।
পাকিস্তানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের নেতৃত্বে লংমার্চ হয়েছে। সেই লংমার্চে লাখো মানুষ জড়ো হয়। ক্রিকেট খেলোয়াড় থেকে রাজনীতিতে আসা ইমরান খান নির্বাচনের দাবিতে লংমার্চ করেন। পাকিস্তানের বর্তমান শাহবাজ শরিফের সরকারকে তিনি ‘আমদানি করা সরকার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি তার ডাকা লংমার্চকে দেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লংমার্চ হিসেবে উল্লেখ করে ভবিষ্যতে আরো কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
লংমার্চের অভিজ্ঞতা বিএনপিরও আছে। বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখী লংমার্চ হয়েছে। পার্বত্য কালো চুক্তির প্রতিবাদে ১৯৯৮ সালের ৯ জুন দুই দিনব্যাপী খালেদা জিয়ার ওই লংমার্চ দেশব্যাপী তোলপাড় তুলেছিল। ঢাকার পল্টন ময়দান থেকে লংমার্চ শুরু হয়। কিন্তু কাঁচপুরে আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী রাস্তায় ট্রাক ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে লংমার্চ আটকে দেয়। এ অবস্থায় খালেদা জিয়া হাজার হাজার জনতা নিয়ে কাঁচপুরে অবস্থান নেন। জনস্রোত বাড়তে থাকলে সন্ধ্যার পর ব্যারিকেড তুলতে বাধ্য হয়। লংমার্চ এগিয়ে গেলে লাখো মানুষ এতে শরিক হয়।
লংমার্চ রাজনীতির এক আলোড়ন। খালেদা জিয়ার পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখী লংমার্চ সে দিন রাজনীতিতে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। আলোড়িত হয়েছিল। এর আগে বাংলাদেশের মানুষ মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ প্রত্যক্ষ করেছে। কলকাতা বন্দরের নাব্য রক্ষার যুক্তি দেখিয়ে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণে হাত দেয়। বাংলাদেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশে এ বাঁধ এক বড় অন্ধকার হিসেবে দেখা দেয়। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত থেকে ভারতে ১৮ কিলোমিটার ভেতরে গঙ্গা নদীর ওপর ‘ফারাক্কা বাঁধ’ নির্মাণ করে ভারত। এ বাঁধের প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানির জন্য হাহাকার তৈরি হয়। বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে রাজশাহী থেকে এক লংমার্চ কর্মসূচি দেন মওলানা ভাসানী। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের দিকে রওনা হয় এই লংমার্চ। মওলানা ভাসানী বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ১৯৭৬ সালের গোড়ার দিকে। চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ফেরার পর লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ওই কর্মসূচি তখন রাজনৈতিক মহলসহ দেশের মানুষকে চমকে দেয়। জনগণকে দেশপ্রেমে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করে। তখন মওলানা ভাসানীর বয়স ৯০ বছর। ওই বয়সে বিছানায় থাকার কথা। কিন্তু দেশের বিপদে একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ হয়ে নবতিপর মজলুম এই জননেতা চুপ করে থাকতে পারেনি। কর্মসূচি ঘোষণার পর ৩১ সদস্যবিশিষ্ট ‘ফারাক্কা লংমার্চ পরিচালনা কমিটি’ গঠিত হয়। লংমার্চের আগে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখেন মওলানা ভাসানী। চিঠিতে লংমার্চের কারণ বর্ণনা করেন। ১৬ মে রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে লংমার্চ শুরু হয়। রাজশাহী থেকে প্রেমতলী, প্রেমতলী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সেখান থেকে মনকষা এবং মনকষা থেকে শিবগঞ্জ পর্যন্ত ৬৪ মাইল দীর্ঘ পথজুড়ে লংমার্চের পুরোভাগে মওলানা ভাসানীসহ নেতারা ছিলেন। লংমার্চ চলাকালে মুষলধারে বৃষ্টি নামে। কিন্তু লাখো জনতা বৃষ্টি উপেক্ষা করে লংমার্চ এগিয়ে নেন। কানসার্টে লংমার্চ পৌঁছে। বিকেল ৪টায় মওলানা ভাসানী জনসমুদ্রে বলেন, ফারাক্কা সমস্যা সমাধানে ভারত যদি বাংলাদেশের জনদাবি উপেক্ষা করে, তা হলে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু হবে।
মাও সেতুং ও গান্ধীর লংমার্চ
আজকের চীন মাও সেতুংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও লংমার্চের ফসল। ১৯৩৪ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৩৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে চীনে যে দীর্ঘস্থায়ী পদযাত্রা হয়, ইতিহাসে সেটিই মাও সেতুংয়ের লংমার্চ নামে পরিচিত। মাও সেতুং গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে দেখেন চিয়াং কাই-শেকের বাহিনী লাল ফৌজকে বেস্টন করে রেখেছে। তাৎক্ষণিকভাবে নিজের সামরিক পরিকল্পনা পরিবর্তন করেন তিনি। ওই সময় মাওয়ের নেতৃত্বে লাল ফৌজ শত্রুর অবরোধ ভেঙে অর্থাৎ প্রায় ৯০ হাজার ফৌজের সৈনিক কুওমিঙটাংদের বেড়া ভেঙে বেরিয়ে পড়ে। মাওয়ের লংমার্চ শুরু হয়েছিল চিয়াংশি প্রদেশ থেকে এবং শেষ হয়েছিল পীতে নদীর তীরে অবস্থিত শেনসি প্রদেশে। দীর্ঘ ছয় হাজার মাইল পথ অতিক্রম করার সময় লাল ফৌজ ১১টি প্রদেশ পাড়ি দেয়। বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে ঝড়বৃষ্টিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে, ১৮টি পর্বতমালা, ২৪টি নদী অতিক্রম করে লংমার্চ যখন গন্তব্যে পৌঁছে, তখন ৯০ হাজার সৈন্যের মধ্যে ৪৪ হাজার সৈন্য বেঁচে ছিলেন। লংমার্চে ভীত হয়ে চিয়াংকাইশেক ও তার বাহিনী বর্তমান তাইওয়ান দ্বীপে পালিয়ে যান।
ইতিহাসে আরেকটি ঐতিহাসিক লংমার্চের কথা লেখা আছে, মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীর ডান্ডি পদযাত্রা। ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশদের একচেটিয়া লবণ নীতির বিরুদ্ধে গান্ধী ‘লবণ সত্যাগ্রহ’ শুরু করেন। এটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ওই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ ডান্ডি পদযাত্রা বা লংমার্চ শুরু হয় গান্ধীর সবরমত আশ্রম থেকে। মোট ২৪ দিনে ২৪০ মাইল পথ হেঁটে ডান্ডি গ্রামে এসে বিনা করে সমুদ্রের পানি থেকে লবণ প্রস্তুত করেন গান্ধী। দিনটি ছিল ১৯৩০ সালের ৬ এপ্রিল। তার সাথে লাখো অনুসারীও লবণ আইন ভেঙে নুন তৈরিতে লেগে যান।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য প্রতিষ্ঠার পর তাদের এমনই একটি লংমার্চের ডাক এখন সময়ের দাবি। হয়তো সে দিন দূরে নয়, আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এমনই এক লংমার্চ কর্মসূচি দেখতে পাবো।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
Leave a Reply