‘বনের বাঘে খায় না মনের বাঘে খায়।’ প্রাচীন এই উপকথার হালের উদাহরণ আমাদের ক্রিকেট থেকে ভালো আর কী হতে পারে! ইতিহাসের ভয়াবহতম রাজনৈতিক বিপর্যয় আর জরুরি খাদ্য-শস্য, জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অভাবে ধুঁকছে যে দেশ, কিংবদন্তীদের বিদায় আর সম্ভাবনাময়দের অভিমানে নড়বড়ে যে দেশের ক্রিকেট; সেই দেশের ক্রিকেটাররা এসে কী সুন্দর হেসে সিরিজ জেতার সুখ নিলো বীরের বেশে। অথচ যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা আর শক্তিমত্তা; সব দিক থেকে ছিলাম আমরাই এগিয়ে।
কথায় আছে-
মনের বাঘ হিংস্র বড়, যাস না তো কভু ভুলে
হারার আগে হেরে যাবি, তার লেজ চুলকালে!
কিন্তু তা আর মনে রাখতে পারলো কই? নিজেদের পরিচয় ভুলে, চালান হয়ে গেলো মনের বাঘের পেটে। বনের বাঘ খায়নি তাদের, মনের বাঘে খেয়েছে। হারাতে হয়নি তাদের, তারাই হেরে গিয়েছে। উঠতি বয়সী তরুণী যেমন স্বপ্ন দেখে, উড়ন্ত ঘোড়ায় চেপে স্বপ্নের রাজকুমার আসছে তাকে নিতে। তেমনি তারা আসিথা, রাজিথাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে স্টার্ক, আন্ডারসন ভেবে বসে আছে। যার ফলাফল তো হাতেনাতে দিতে হয়েছে৷ আর চতুর শেয়ালের মতো বলতে হচ্ছে ‘আঙ্গুর ফল টক।’
অথচ যাদের কাছে সিরিজ খোয়ালো, বাংলাদেশই শুধু তাদের জন্য আলো। বাকিটা অন্ধকারে ঘেরা, কখনো আবছা আবছা। এই সিরিজের আগে তিন টেস্ট খেল মোটে ৪ উইকেট ছিল আসিথার ঝুলিতে। আর ৯ টেস্টে উইকেট ২৫ উইকেট ছিল রাজিথার। যদিও খানিকটা এগিয়ে, তবুও ভালো বলা টেকে না ধোঁপে।
আরো অবাক করা তথ্য হলো, লঙ্কানরা স্পিনারে ভরসা করেই দল সাজিয়েছিল। স্পিন দিয়েই বাঘেদের ঘায়েল করবে ভেবেছিল। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল- আসিথা, রাজিথা তাদের কাছেও বিস্ময়ই ছিল। অনেকটা অন্ধের দেশে আয়না বিক্রির ঘটনা।
এদিকে মুমিনুল বাহিনীকে এখন আর পড়া যায় না। সুন্দরী তরুণীর মনের মতোই যেন প্যাঁচানো। কখন কী হয়ে যায়, বলাটা বড় দায়। বিদেশ সফরে স্পিনে ধস নামে, ১০ উইকেটের সব ক’টিই দিয়ে আসে তাদের পকেটে। অথচ যাওয়ার আগে সুইং আর বাউন্সের ভয় পেয়ে থাকে। আবার এর উল্টাটা দেশে। স্পিনের রাজত্বে ধরাশায়ী হয় পেসারদের হাতে! স্কোরকার্ড দেখে খেলাটা লর্ডসে মনে হবে। বিষয়টা যেন এখন আনকমন প্রশ্নের মতো হয়ে আছে।
আর ব্যাটিং যেন যাচ্ছেতাই। যেন ভুলে বসে আছে ব্যাটিং ব্যাকরণের সবটাই। শুরুর আগেই ধস নামিয়ে দর্শকেরা সিট গরম করার আগেই অর্ধেক দল সাজঘরে। ফলে মুরব্বিদের সাথে খেলা দেখতে বসলে, বার বার শুনতে হয়- ‘তামিম, মুমিনুল নেমেছ?’ এদিকে অধিনায়ক সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। দলের ব্যর্থতার সাথে নিজের ব্যাটও নিস্প্রভ। শেষ ১৫ ইনিংসে তার রান- ০, ৯, ২, ৫, ৬, ০, ২, ০, ৩৭, ৮৮, ১৩, ১, ৭, ৬, ০। অপরদিকে ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড ওয়ানডাউনও মিটমিটে। বিশ্ব যখন স্মিথ, কোহলি, বাবর, রুটরা এই জায়গায় খেলছে। তখন আমাদের ভরসা নাজমুল হাসান শান্তে। শেষ ইনিংসগুলোও বলে না তার পক্ষে। ২, ৮, ১, ৭, ৩৩, ২৬, ৩৮, ২৯, ৪, ১৭, ৬৪, ৬, ০।
কতটা খারাপ অবস্থায় আমাদের টেস্ট দল, তা বোঝাতে একটা পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। শেষ চার ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে আউট হয়েছেন ৬৯ জন ব্যাটসম্যান। যার মাঝে ২৭ জনই কোনো রান করতে পারেননি। তাদের মাঝে ডাক (০) মেরেছেন ২১ জন। আবার ১০ রানের কমে আউট হয়েছেন আরো ২১ জন। আর ৩০ স্পর্শ করতে পারেননি আরো ১৪ জন ব্যাটসম্যান। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ৬৯ ব্যাটারের মাঝে ৬২ জনই ৩০ রানের গণ্ডি পাড়ি দিতে পারেননি।
বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন কিংবা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান স্বীকার করেছেন, ক্রিকেটাররা টেস্ট খেলতে গেলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। আর বিশেষ করে দ্বিতীয় ইনিংসের নিজেরা অবসাদে ভোগেন। নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তা পরিষ্কার করবে আরেকটা পরিসংখ্যান। বাংলাদেশের খেলা শেষ তিনবার ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ অলআউট হয়েছে ৫৩, ৮০, ও ১৬৯ রানে৷
ফলে বোঝাই যাচ্ছে, দলকে বনের বাঘে নয়, মনের বাঘে খেয়েছে। বিসিবি ভালো করেই জানে এই জন্য কী করা প্রয়োজন, আশা করি তারা ব্যবস্থা নেবে।
Leave a Reply