প্যান্ডোরা পেপারসে সর্বশেষ ধাপে প্রকাশিত তিন বাংলাদেশির একজন শাহিদা বেগম শান্তি। বিশেষভাবে তাঁর কোনো পরিচিতি না থাকলেও সম্প্রতি প্যান্ডোরা পেপারসে নাম আসার পর তাঁকে নিয়ে কৌতূহল শুরু হয় সিলেটে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার রায়গড়ের মৃত সিরাজ উদ্দিনের মেয়ে শাহিদা। স্বামী মিসবাহ উদ্দিন ওরফে রবিন চৌধুরী।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শাহিদা ও মিসবাহর নামে ২০১৫ সালে অর্থপাচার আইনে মামলা করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যে জালিয়াতি করে এই দম্পতি বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। সেই জালিয়াতির প্রায় ৪৪ কোটি টাকা তাঁরা দেশে এনেছেন। সেই মামলা এখনো বিচারাধীন।
গোলাপগঞ্জের একজন জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শাহিদা বেগম রায়গড়ের মেয়ে। তাঁর স্বামীর নাম রবিন চৌধুরী বলে জানি। তাঁরা বিদেশে থাকেন শুনেছি। তবে সেভাবে বিস্তারিত কিছু জানি না। ’ শাহিদা-মিসবাহ দম্পতির বিষয়ে জানতে দুদকের মামলায় উল্লেখ করা মিসবাহর ঠিকানা ধরে সিলেটের শাহজালাল উপশহরে গিয়ে তাঁর ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া যায়। ‘স্প্রিং গার্ডেন’ নামের একটি ভবনে ওই ফ্ল্যাট। ওই ভবনের রিসিপশন ইনচার্জ মুজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্প্রিং গার্ডেনের সাত তলায় শাহিদা বেগম শান্তি ও তাঁর স্বামী মিসবাহ ওরফে রবিন চৌধুরীর একটি ফ্ল্যাট আছে। তাঁরা প্রবাসে থাকেন। দেশে এলে এখানে থাকেন। ’ একটি সূত্র জানায়, মিসবাহ ওরফে রবিন গেল রমজানের প্রথম দিকে এই ফ্ল্যাটেই ছিলেন। ১৫ রমজানের দিকে সম্ভবত বিদেশে চলে গেছেন। আর শাহিদা প্রায় আড়াই বছর ধরে এখানে আসেননি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্প্রিং গার্ডেনের এই ফ্ল্যাটের মালিক শাহিদা বেগম। ২০১২ সালে ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় এই ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে।
দুদকের মামলা সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের ১২টি ব্যাংকের সিলেটের ১৫টি শাখার মাধ্যমে নানা কৌশলে বাংলাদেশে ৪৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা আনেন শাহিদা-মিসবাহ দম্পতি। বেশির ভাগ টাকা আসে শাহিদার ব্যাংক হিসাবে। বাকি টাকা আসে তাঁর স্বামী মিসবাহ, শ্বশুর আব্দুর রহিম, ভাই রিপন সিরাজ ও স্বামীর মামা মাখন উদ্দিনের ব্যাংক হিসাবে। অবৈধভাবে আনা এসব টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হয়। সিলেট নগরে জমি ও ফ্ল্যাট, গাড়ি, ফার্নিচার কেনা এবং বিভিন্ন ব্যাংকে সঞ্চয়ী ও মেয়াদি আমানত হিসাব খোলা হয়। তবে তাঁদের সব ব্যাংক হিসাব ও শেয়ার স্থগিত করা হয়েছে। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে ২০১৫ সালের ২০ মে দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী বাদী হয়ে সিলেট কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি শাহিদা বেগম, মিসবাহ উদ্দিন, আব্দুর রহিম, রিপন সিরাজ ও মাখন উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
দুদকের সিলেটের সরকারি কৌঁসুলি ইবনে আলী মো. লুত্ফুর কিবরিয়া (শামীম) বলেন, ‘মিসবাহ উদ্দিন ও শাহিদার বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলাটি বিভাগীয় স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এখন সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ’
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক জোট ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস বা আইসিআইজে লাখ লাখ নথি ফাঁস করে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, সেটাই ‘প্যান্ডোরা পেপারস’ নামে পরিচিত। করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের অফশোর কম্পানিতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অর্থ ও গোপন লেনদেনের তথ্য ফাঁস করা হয় প্যান্ডোরা পেপারসের নথিতে। গত বছরের ৩ অক্টোবর প্যান্ডোরা পেপারসের প্রথম ধাপের তালিকা প্রকাশ করা হয়। তিন ধাপে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে মোট ১১ জন বাংলাদেশির নাম এসেছে।
প্যান্ডোরা পেপারসের তথ্য অনুযায়ী জাস লিমিটেড নামের একটি অফশোর কম্পানিতে বিনিয়োগ রয়েছে শাহিদার। তিনি সেখানে ঠিক কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন, তা জানা যায়নি। এসব বিষয়ে জানতে শাহিদা বেগম ও মিসবাহ ওরফে রবিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁদের পাওয়া যায়নি।
যোগাযোগ করা হলে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় সিলেটের উপপরিচালক নূর-ই-আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শাহিদা-মিসবাহ দম্পতির বিরুদ্ধে মামলার বিচারকাজ শেষের দিকে। আরো দু-তিনজনের সাক্ষ্য নেওয়া হবে। এর পরই মামলার রায় হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। ’ আসামিরা কে কোথায় আছেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সে সময় সব আসামিকেই আদালতে হাজির করা হয়েছিল। তবে সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। ’
Leave a Reply