গত ডিসেম্বরের প্রথম ১০ দিনে র্যাব-পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সারাদেশে ১১ জন নিহত হয়। সর্বশেষ গত ১০ ডিসেম্বর বরগুনার পাথরঘাটায় র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এক ডাকাতের মৃত্যু হয়। সেই বন্দুকযুদ্ধের কয়েক ঘণ্টা পরেই র্যাবের সাবেক-বর্তমান সাত শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সামনে আসে। এর পর প্রায় চার মাসে (১১৫ দিন) কোনো ক্রসফায়ার বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ খবর পাওয়া যায়নি। বলা যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অলিখিত লাগাম টানা হয়েছে। তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে স্বাধীন কমিশন প্রয়োজন বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তারের আগেই একজন এবং গ্রেপ্তারের পর মারা গেছেন দ্জুন। তবে এই সময়ে বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে দেশে কোনো হতাহতের খবর মেলেনি।
বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের বিরতি দেখা গিয়েছিল কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদের হত্যাকাণ্ডের পর। ২০২০ সালে ৩১ জুলাই ওই হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় পাঁচ মাস বন্দুকযুদ্ধ অনেকটাই বন্ধ ছিল। ওই সময়ে কেবল (২ আগস্ট) সিলেটে বন্দুকযুদ্ধের একটি ঘটনা ঘটে। আইন সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, মেজর সিনহা নিহত হওয়ার আগের সাত মাসে দেশে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৮৪ জন নিহত হয়।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, সিনহা হত্যার পর তিন মাস ক্রসফায়ার বন্ধ ছিল। আবার মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর এখন সাময়িক বন্ধ আছে। এটা প্রমাণিত যে, সরকার বিচারবহিভর্‚ত হত্যা বন্ধ অথবা চালু রাখতে পারে। তবে এই সাময়কি বন্ধ হওয়া স্থায়ী সমাধান নয়। বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকাণ্ড স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের মাধ্যমে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে গত ১০ ডিসেম্বর র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুসারে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ৬৪৪ জন ব্যক্তি বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকাÐের শিকার হন। অধিকাংশ বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকাণ্ড ক্ষেত্রেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দাবি, নিজেদের আত্মরক্ষার জন্যই অপরাধীদের ওপর গুলি চালাতে হয়েছিল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়। বাংলাদেশের আইন ও সংবিধানও সেই অনুমতি দিয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে এ ধরনের গুলিবিনিময় বেশি হয়। কিন্তু গত ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে বিভিন্ন অভিযানে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি না হওয়ায় বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেনি।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর ক্রসফায়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রমাণ করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিচারবহির্ভ‚ত হত্যাকাণ্ড চাইলেই বন্ধ করতে পারে। আগের ঘটনাগুলো ছিল একপক্ষীয় ও সাজানো।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেন, ‘আমরা আমেরিকানদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের আয়োজন করেছি। আমরা যখনই তথ্যগুলো সঠিকভাবে তাদের কাছে পৌঁছাতে পারব, আমার বিশ্বাস, র্যাবের মতো একটি অত্যন্ত ভালো প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে নিশ্চয়ই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে। তবে সময় লাগবে।’
তবে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ক‚টনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনসহ দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিতে ওয়াশিংটনে পৌঁছেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি বিøনকেনের সঙ্গে আবদুল মোমেনের সোমবারের বৈঠকে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনান্ড লুই গত রবিবার এক প্রতিবেদনে বলেন, ‘বাংলাদেশে গত চার মাসে বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকাণ্ড বা গুমের কোনো ঘটনা পাওয়া যায়নি। আমরা আশা করি এটি অব্যাহত থাকবে। সরকার বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিযুক্তদের আইনের অধীনে জবাবদিহি করবে। এটি আমাদের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা অংশীদারত্ব আরও নিবিড় করতে সাহায্য করবে।’ সন্ত্রাস দমনে তার সরকার পুলিশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ চালিয়ে যাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
Leave a Reply