মাহে রমজান আমাদের দুয়ারে উপস্থিত। পবিত্র এ মাসে বিশ্বের মুসলমানরা সিয়াম সাধনায় মশগুল থাকেন। এটি মুসলমানদের জন্য অবশ্য পালনীয় ইবাদত। তবে যারা অসুস্থ কিংবা সফরে থাকেন, তাদের জন্য রোজা রাখার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ছাড় রয়েছে। ডায়াবেটিস এক জটিল বিপাকীয় ব্যাধি। ছাড় থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের মুসলমানরা আধ্যাত্মিক ফায়দা লাভের আশায় রমজান মাসের রোজা রাখছেন।
পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীতে ১৫০ মিলিয়ন মুসলিম নর-নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে বিশাল সংখ্যক ডায়াবেটিস রোগী রমজান মাসে রোজা রাখছেন। কারও কারও রোজা রাখায় কোনো ঝুঁকি না থাকলেও অনেকের ক্ষেত্রে রোজা রাখায় জীবনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। রোজা রাখলে যেসব ডায়াবেটিস রোগীর জীবনের ঝুঁকি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাদের রোজা না রাখাই উত্তম। রোজার আগেই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে এ বিষয়ে ডায়াবেটিস রোগীদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার কারণে ডায়াবেটিস রোগীদের বিপাকীয় কার্যক্রমে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে অথবা বেড়ে যেতে পারে। কখনো কখনো কিটো-অ্যাসিডোসিস নামক এক জটিলতা তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া গরম আবহাওয়ায় দীর্ঘ সময় পানি পান না করার কারণে পানিশূন্যতার সৃষ্টি হতে পারে। এতে ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের ভেতরে থ্রম্বোসিস তৈরির ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে এসব জটিলতা নির্ভর করে অনেক বিষয়ের ওপর। রোগীর বয়স, ডায়াবেটিসের ধরন, ডায়াবেটিসের সময়কাল, অন্যান্য রোগ, বিশেষত কিডনি রোগের উপস্থিতি, ডায়াবেটিসের জন্য ব্যবহৃত ওষুধ, ইনসুলিনের মাত্রা, শরীরচর্চার ধরন ইত্যাদি ডায়াবেটিস রোগীদের বিপাকীয় কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে। আবার রোগীর রক্তে চিনির মাত্রা কমে যাওয়ার প্রবণতা এবং তা কমে গেলে উপলব্ধি করার ক্ষমতা থাকা বা না থাকার ওপর জীবনের ঝুঁকি নির্ভর করে।
রমজান মাসে আমাদের খাদ্য শৃঙ্খলায় কিছুটা ব্যত্যয় ঘটে। রোজার মাসে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকতে হয়। ইফতার ও সেহরির মাঝে অল্পসময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার খেতে হয়। এ ছাড়া এ সময় ঐতিহ্যগতভাবে বেশকিছু খাবার আমাদের খাদ্য তালিকার মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। এর মধ্যে কোনো কোনো খাদ্য রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ হুহু করে বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে ডায়াবেটিস রোগীদের প্রায়ই রক্তে গ্লুকোজের আধিক্য সৃষ্টি হয়।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ইফতারের সময় অতিরিক্ত ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ১ হাজার ৫০০ কিলোক্যালরি ছাড়িয়ে যায়। ফিরনি, হালুয়া, জিলাপি, বুন্দিয়া, দই, মিষ্টিসহ আরও মিষ্টিজাতীয় ফল ইফতারের খাদ্য তালিকায় থাকে। তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের শরবত তো রয়েছেই। ছোলা, মুড়ি, হালিমসহ কত বাহারি খাবারের প্রাচুর্য ইফতারের সময় দেখা যায়। ভাজাপোড়া খাবারের কথা না-ই বা বললাম। ইফতার ও সেহরির মাঝখানেও অনেকে বিভিন্ন ধরনের খাবার গ্রহণ করে থাকেন। সবকিছু মিলিয়ে এ সময় পর্যাপ্ত ক্যালোরি গ্রহণ করায় ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেরই রোজার সময় স্থূলতা বৃদ্ধি পায়। এ জন্য রমজানের সময় অবশ্যই খাদ্য তালিকার দিকে নজর দিতে হবে।
শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরি জোগান দেওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাবার গ্রহণ অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। তবে সেসব খাদ্যগ্রহণ থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে- যা রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ খুব দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। চিনির তৈরি মিষ্টি খাবার, ময়দাজাত খাবার কিংবা কলে ছাঁটা চালের বদলে খাদ্য তালিকায় স্থান দিতে হবে তন্তুজাতীয় শর্করা, গোটা শস্যদানা, শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি।
যেসব ডায়াবেটিস রোগী ইনসুলিন গ্রহণ করছেন, চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে রমজানের আগেই তারা ইনসুলিন সমন্বয় করে নেবেন। যারা দুবেলা প্রাক-মিশ্রিত ইনসুলিন নিচ্ছেন, তারা সকালের সমপরিমাণ ইনসুলিন ইফতারের সময় নেবেন। রাতের ইনসুলিনের ডোজ অর্ধেক পরিমাণ কমিয়ে সেহরির সময় নেবেন। যারা স্বল্পসময়ে ক্রিয়াশীল ইনসুলিন তিনবেলা খাওয়ার আগে নিচ্ছেন, তাদের দুপুরের ইনসুলিন বাদ পড়বে। সকালের সমপরিমাণ ইনসুলিন ইফতারের সময় নেবেন। রাতে নেওয়া ইনসুলিনের মাত্রা কমিয়ে সেহরির সময় নিন। অন্য ধরনের ইনসুলিনের মাত্রা চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে সমন্বয় করে নেবেন। ডায়াবেটিস রোগীরা যেসব ওষুধ খেয়ে থাকেন, রমজানের সময় তাও ক্ষেত্রবিশেষে সমন্বয় করতে হয়। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
রোজা রেখে ইনসুলিন নিলে কিংবা রক্তের পরীক্ষা করালে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। ডায়াবেটিস রোগীরা যখনই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়ার লক্ষণ অনুভব করবেন, তখনই তারা গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করিয়ে নেবেন। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা প্রতিলিটারে ৩ দশমিক ৯ মিলিমোলের নিচে নেমে গেলে গ্লুকোজ বা চিনির শরবত খেয়ে রোজা ভেঙে ফেলবেন। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে গেলে বা হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় আক্রান্ত হলে সমূহ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীরা রোজা রেখে এ বিষয়ের ওপর অবশ্যই নজর রাখবেন।
লে. কর্নেল ডা. নাসির উদ্দিন আহমদ : চিকিৎসক ও কলামিস্ট এবং মেডিসিন স্পেশালিস্ট ও এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট, সিএমএইচ এবং আল রাজি হাসপাতাল, ফার্মগেট, ঢাকা
Leave a Reply