গুজব, গুঞ্জন ও প্রশ্নের শহর ফরিদপুর। সেখানে তিন দিনে লোকজনকে একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দেখেছি সবচেয়ে বেশি। কী ঘটতে যাচ্ছে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাগ্যে? সদর আসনের সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ফরিদপুরের রাজনীতি ও প্রশাসনে তার কথাই ছিল প্রথম এবং শেষ। কিন্তু গেল বিশ মাসে পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। তার কাছের বেশ কয়েকজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এক সময় যা ছিল অচিন্তনীয়। আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল শহর আওয়ামী লীগের বহুল আলোচিত সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন বরকত, তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেল এবং যুবলীগ নেতা এইচ এম ফুয়াদকে।
সর্বশেষ গ্রেপ্তার করা হয় খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে। এ গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে খন্দকার মোশাররফ অবশ্য প্রকাশ্যে কোনো অবস্থান নেননি। প্রতিবাদও করেননি। শহরে এটা চাউর আছে যে, ২০১৮ সালের পর থেকে ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল খন্দকার মোশাররফের।
খন্দকার পরিবারের রাজনীতির ভবিষ্যত যে অনিশ্চিত তা পার্টি অফিস কিংবা প্রেস ক্লাবে কান পাতলেই বুঝা যায়। খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ফুলস্টপ দেয়া হয়ে গেছে বলে অনেকেই মনে করেন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহা জানান, বাবরকে তারা বহিষ্কার করেছেন। কেন্দ্র ইতিমধ্যে তা অনুমোদনও করেছে। যদিও তিনি মনে করেন বাবর কখনো আওয়ামী লীগার ছিল না। তবে কথা থেকে যায় জেলা কমিটি এসব অপকর্মের দায় এড়াতে পারে কি? এর জবাবে তিনি বলেন, এটা কখনো মেনে নেইনি। কিন্তু তখন প্রতিবাদের কোনো ভাষা ছিল না। যারাই প্রতিবাদ করেছে তাদের ওপর হামলা করেছে। নির্যাতন করেছে। আমাকে সবসময় কটু কথা বলতেন।
তিনি নিজে খন্দকার মোশাররফের অনুসারী ছিলেন এমন মন্তব্যের জবাবে সুবল চন্দ্র সাহা বলেন, তাদের শাসনামলে আমি সহ-সভাপতি ও সভাপতি ছিলাম। উনি সংসদ সদস্য। গঠনতন্ত্র মোতাবেকই ওনার সঙ্গে সংহতি রেখে আমাকে কাজ করতে হয়েছে।
ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখন প্রধানত দু’টি বিষয় আলোচিত হচ্ছে। প্রথমত, বলা হচ্ছে বাবর-বরকত-রুবেলের অনেক সহযোগী এখনো রাজনীতিতে পুরোমাত্রায় সক্রিয়। তারা নেতা পরিবর্তন করেছেন এই যা। দ্বিতীয়ত, সহসাই আওয়ামী লীগের সম্মেলন হতে পারে। সেখানে কারা নেতৃত্বে আসতে পারেন তা নিয়ে ভালোই গবেষণা চলছে। যদিও সব নেতাই এক বাক্যে বলছেন, বিষয়টি পুরোই নির্ভর করছে দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। তৃতীয় আরেকটি বিষয় নিয়েও কিছুটা আলোচনা হচ্ছে। খন্দকার মোশাররফ হোসেনই কী আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন? তিনি প্রার্থী না হলে কে হবেন প্রার্থী? প্রেসিডিয়াম সদস্য, কাজী জাফরুল্লাহকে নিয়ে তৈরি হয়েছে গুঞ্জন। যদিও জেলার রাজনীতিতে তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এক নেতা জানালেন, জাফরুল্লাহ কখনো তাকে এ ধরনের কথা বলেননি।
বাবর-বরকত-রুবেলের হেলমেট বাহিনী ছিল শহরে এক আতঙ্কের নাম। পুরো শহরেই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল তারা। টেন্ডারবাজি, অনিয়ম, দুর্নীতি ছাড়াও রাজনীতিতেও তারা একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন বলছিলেন, বাবর প্রায়ই বলতেন, কে কবে কী ত্যাগ স্বীকার করেছেন ভুলে যান। আমরা যা বলবো ফরিদপুরে তাই হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সিন্ডিকেটের অল্প কয়েকজন সদস্যইতো গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকিরা কোথায়? কোথায় উধাও হয়েছেন তারা। অভিযোগ উঠেছে তাদের অনেকে এখনো রাজনীতিতে পুরোমাত্রায় সক্রিয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় মিশে গেছেন তারা। সৈয়দ মাসুদ হোসেনের কাছে সরাসরিই জানতে চেয়েছিলাম বিষয়টি। তিনি অস্বীকার করলেন না। পুরো বিষয়টিরই একটা ব্যাখ্যা আছে তার কাছে। তিনি বলেন, ক্ষমতার প্রভাববলয়ে থাকার জন্য অনেকেই তাদের ছত্রছায়ায় গিয়েছিল। পটপরিবর্তনের পর তাদের অনেকে আমাদের কাছে আসছে। আমরা কাউকে কাউকে গ্রহণ করছি, কাউকে কাউকে করছি না। তারা যে জন্মগতভাবে পাপী এমনটা নয়। সবাইকে বাদ দিয়ে তো রাজনীতি হয় না। তবে জেলায় এখন কোনো টেন্ডারবাজি হচ্ছে না বলে দাবি করেন তিনি।
জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শামীম হকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম পুরো বিষয়টা। তিনি মনে করেন ফরিদপুরে একটি শাসনামলের অবসান ঘটেছে। তিনি বলেন, তাদের বাইরে কারওতো কিছু করার উপায় ছিল না। তাদের যারা সহযোগী ছিল তারা এখনো রাজনীতি করছে। যারা সহ্যের বাইরে চলে গিয়েছিল কেবল তাদেরই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে শুদ্ধি অভিযান আরও তীব্র হবে বলে আশা এই আওয়ামী লীগ নেতার। তিনি বলেন, আগামীদিনে এই শুদ্ধি অভিযান আরও তীব্র হবে বলে আমি আশা করি এবং আমি মোটামুটি জানি যে এটা হবে।
সহসাই হতে পারে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন। শহরে যে কেউ পা রাখলেই অবশ্য তা বুঝতে পারবেন। নেতাদের ব্যানার ও ফেস্টুনের ছড়াছড়ি। আগ্রহীদের তালিকা দীর্ঘ। তবে জেলা আওয়ামী লীগের তিন শীর্ষ নেতাই একযোগে বললেন, পুরো বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর নির্ভর করছে। শামীম হক বলেন, পুরোমাত্রায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে আছি। নেত্রী যে কাজই আমাকে দিয়ে করাতে চান তার জন্য আমি প্রস্তুত আছি।
জেলায় সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের এক নেতার ভূমিকা নিয়েও বিপুল আলোচনা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের রাজনীতির যখন এই অবস্থা তখন ফরিদপুরে বিরোধী শিবিরের রাজনীতি কেমন চলছে? চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মৃত্যুর পর এখানে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করছে। এ আসনে কে হতে পারেন বিএনপির কাণ্ডারি? এখানে দলটির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা হতে পারে শিগগিগরই। উন্মুক্ত ময়দানে বিএনপির কোনো কার্যক্রম নেই, সুযোগও নেই। হামলা, মামলায় জেরবার নেতাকর্মীরা। ২০১৪ সনের পর পার্টি অফিস আর খোলা হয়নি। বিএনপি নেতা সৈয়দ মোদাররেস আলী ইছা বলেন, আমাদেরকে উন্মুক্ত স্থানে কোনো কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেয়া হয় না। আইনজীবী সমিতি ভবনে আমরা আমাদের কর্মসূচি পালন করি। তবে অবাধ ভোট হলে তারা জয়ী হবেন বলে দাবি করেন এই বিএনপি নেতা। এ আসন থেকে একবার ভোটে লড়েছিলেন জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। তবে ভরাডুবি হয় তার। পরে যুদ্ধাপরাধ মামলায় তার মৃত্যদণ্ড কার্যকর হয়। দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন নেই এখন। এর বাইরেও এখানে দলটির কোনো কার্যক্রমের খবর পাওয়া যায় না। অন্য দলগুলোর অবস্থাও প্রায় একই।
Leave a Reply