হিজরি বা চান্দ্র মাসের অষ্টম মাস শাবান। শাবান আরবি শব্দ, অর্থ শাখা প্রশাখা। আর শাবান মাস এলেই চার দিকে ইবাদতের সুবাতাস বইতে শুরু করে। মুমিন হৃদয় জেগে ওঠে। নিজেকে প্রভুপ্রেমে বিলিয়ে দেন বিনীদ্র রজনীতে।
ইবাদত-বন্দেগিতে কাটান দিনের বেশির ভাগ সময়। রমজানের প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে মানসিকভাবে গড়ে তোলার অপূর্ব সুযোগ শাবান মাস। এ শাবান মাস হাদিসের আলোকে বিভিন্ন বিবেচনায় একটি ফজিলত ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস। মুসলিম উন্মাহর এ মাসে কিছু করণীয় রয়েছে। শাবান মাসের আগের মাস হচ্ছে রজব।
বিভিন্ন হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় হজরত মুহাম্মদ সা: পবিত্র রজব ও শাবানে রমজানের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। রমজানে অধিক ইবাদতের জন্য সময়-সুযোগ বের করতেন। মানসিকভাবে তৈরি হতেন। আর এ কারণেই তিনি পবিত্র শাবানের দিন, তারিখ গুরুত্বসহকারে হিসাব রাখতেন। হজরত আয়েশা রা: বর্ণনা করেন, হজরত রাসূল সা: পবিত্র শাবানের প্রতি এত অধিক লক্ষ্য রাখতেন যা অন্য কোনো মাসের ক্ষেত্রে রাখতেন না। (সুনানে আবু দাউদ ১/৩১৮)
সুতরাং পবিত্র শাবান মাসের দিন-তারিখের হিসাব রাখাটাই সুন্নত এবং মুমিনদের করণীয়। পবিত্র শাবান মাসে অধিক হারে নফল রোজা রাখা উত্তম। এ প্রসঙ্গে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হজরত উম্মে সালামা রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি হজরত নবী করিম সা: শাবান ও রমজান ব্যতীত দুই মাস একাধারে রোজা রাখতে দেখিনি। হজরত আয়েশা রা: বলেন, আমি নবী করিম সা:কে শাবান মাসের মতো এত অধিক (নফল) রোজা রাখতে আর দেখিনি। এ মাসের অল্প কিছু দিন ব্যতীত বরং বলতে গেলে সারা মাসই তিনি নফল রোজা রাখতেন। (জামি তিরমিজি ১/১৫৫)
শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত, অর্থাৎ পনেরো শাবান রাত হচ্ছে পবিত্র শবেবরাত। এ রাতের ব্যাপারে বিশেষ ফজিলত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। বছরের শ্রেষ্ঠ পাঁচটি রজনীর অন্যতম এ রাত। এ রাতের করণীয় সম্পর্কে হজরত মুহাম্মদ সা: ইরশাদ করেছেন, পনেরো শাবান রাতে (শবেবরাত) তোমরা জেগে থেকে ইবাদত করো এবং পরদিন রোজা রাখ। এ জন্য শবেবরাতে জেগে থেকে ইবাদত করা এবং পরদিন রোজা রাখা উত্তম।
সাবান মাসে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ চারটি আমল বা কাজ। যা আমলে নববি হিসেবে বিবেচিত। শাবান মাসে এ আমলগুলো যথাযথভাবে আদায় করতে পারলেই রমজানের ইবাদতগুলো করা সহজ হবে। এসব আমল হলো-
বেশি বেশি রোজা রাখা। হজরত উসামা বিন যায়েদ রা: রাসূলুল্লাহ সা:কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সা: শাবান মাসে আপনাকে যত রোজা রাখতে দেখি, অন্য মাসে এত পরিমাণ রোজা রাখতে দেখিনি। আপনি কেন এ মাসে এত বেশি রোজা রাখেন? রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, এটি এমন একটি মাস, যা রজব এবং রমজানের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি মাসের মধ্যে পড়ে। আর অধিকাংশ মানুষ এ মাসটি সম্পর্কে গাফেল থাকে। যার ফলে তারা ভালো আমল করে না। তারা ভাবে যে, রমজান তো আছেই।’ (নাসাঈ)
এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সা: শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করতেন। বিশ্বনবী সা:-এর এ আমলটি উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য অন্যতম শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা।
রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেন, ‘শাবান মাসে বেশি রোজা রাখার অন্য একটি কারণ হলো- এ মাসে আল্লাহর কাছে মানুষের আমলনামাগুলো উপস্থাপন করা হয়। আর আমি চাই রোজা থাকা অবস্থায় আমার আমলনামা আল্লাহর কাছে উপস্থাপন করা হোক।’ এখন প্রশ্ন থাকতে পারে যে, কখন, কিসের ভিত্তিতে মানুষের আমলনামা আল্লাহর কাছে পৌঁছানো হয়?
হ্যাঁ, ৩ অবস্থায় মানুষের আমলনামা আল্লাহর কাছে পৌঁছানো হয়। তাহলো- দৈনন্দিন ভিত্তিতে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ফেরেশতারা প্রতিদিন এবং রাতে পালাবদল করে তোমাদের (মানুষের ) কাছে আসে। আসরের সময় এবং ফজরের সময় তারা একত্রিত হয়।
অর্থাৎ আসরে একদল আসে আরেক দল চলে যায়। আবার ফজরের সময় একদল আসে আরেক দল চলে যায়। এভাবে ফেরেশতারা দৈনন্দিন ভিত্তিতে মানুষের আমল সকাল-বিকাল আল্লাহর কাছে উপস্থাপন করে থাকে। আল্লাহ তায়ালা তো বান্দার সব অবস্থাই জানেন। তার পরও তিনি সকাল-সন্ধ্যার এসব ফেরেশতাকে তিনি প্রশ্ন করেনÑ তোমরা আমার বান্দাদের কী অবস্থায় রেখে এসেছ? তখন ফেরেশতারা বলেন, আমরা সকাল-সন্ধ্যায় গিয়ে দেখেছি বা দেখে এসেছি, তারা নামাজ পড়ে।
আর সাপ্তাহিক ভিত্তিতে মানুষের আমলনামাগুলো প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আল্লাহর কাছে পৌঁছানো হয়। আর বার্ষিক ভিত্তিতে শাবান মাসে মহান আল্লাহর কাছে মানুষের আমলনামাগুলো পৌঁছানো হয়।
এ কারণেই মানুষের উচিত, শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা পালন করা। বিশেষ করে যদি কেউ সাপ্তাহিক ও মাসিক নির্ধারিত রোজাগুলোও পালন করে তাতেও সহজে ১০-১১টি রোজা পালন করা হয়। তাই শাবান মাসে এ রোজাগুলো গুরুত্বসহকারে পালন করা ফজিলতের কাজ।
তাছাড়া রমজান একটি ফজিলত ও মর্যাদার মাস। এ মাসজুড়ে রোজা পালন ফরজ ইবাদত। রমজানজুড়ে ফরজ রোজা পালনে যাতে কারো মাঝে অলসতা কাজ না করে, রোজা যেন সবার জন্য সহজ হয়ে যায়; সে জন্য রোজার প্রশিক্ষণ হিসেবে শাবান মাসে রোজা পালন করাও উত্তম কাজ। আর তাতেই মুমিনের ভাগ্যে রমজানের পরিপূর্ণ রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত মিলবে। তাছাড়া রোজা একটি অসাধারণ ইবাদত। কেননা রোজা রাখা অবস্থায় কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে সে জান্নাতে যাবে।
হজরত হুজাইফা রা: বর্ণনা করেন, কেউ যদি রোজা রাখা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তবে সে জান্নাতে যাবেন। এ ছাড়া রোজার ফজিলত বর্ণনায় আরো অনেক হাদিস রয়েছে। যার বর্ণনা অনেক চমৎকার। তা হলো রাসূল সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রোজা রাখবেন। কোনো ব্যক্তি ৭০ বসন্তজুড়ে যত পথ অতিক্রম করতে পারবে; ঠিক ওই বান্দাকে জাহান্নাম থেকে আল্লাহ তায়ালা ততটুকু পথের দূরত্বে হেফাজতে রাখবেন। অর্থাৎ রোজার ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ তায়ালা জাহান্নাম থেকে বহু দূরত্বে রাখবেন।
হজরত আবু উমামা রা: আরো বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে এ মর্মে জিজ্ঞাসা করলাম। হে আল্লাহর রাসূল সা: আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলুন; যে আমল করলে আল্লাহ তায়ালা আমাদের অনেক কল্যাণ দান করবেন। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, তুমি রোজা রাখো। অন্য কোনো আমল রোজার মতো হতেই পারে না।’ বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তাবে তাবেয়িন এবং প্রসিদ্ধ ইমামরা শাবান মাস এলেই বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করতেন। কুরআন নাজিলের মাসের বরকত লাভে এ মাসে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করায়ও রয়েছে ফজিলত ও মর্যাদা।
বেশি বেশি সাদাকাহ (দান-সহযোগিতা) করা। অনুরূপভাবে সালফে সালেহিনগণ এ মাসজুড়ে বেশি বেশি দান-সাদকাহ করে রমজানের দান-সাদকার অভ্যাস নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলতেন। যাতে রমজানজুড়ে দান-সাদকায় অতিবাহিত করা যায়। আবার গরিব অসহায়দের রমজানের কষ্ট দূর করা যায়। বেশি বেশি ইসতেগফার করা। রমজানে রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাতের জন্য শাবান মাস থেকেই সালফে সালেহিনগণ বেশি বেশি ইসতেগফার করতেন। যা মানুষকে রমজানজুড়ে আমলে উদ্যোগী করে তোলে।
মুমিন মুসলমানের উচিত, শাবান মাসজুড়ে নিজেদের ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত রাখা। রমজানের প্রস্তুতি নেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখা। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে শাবান মাসজুড়ে উল্লেখিত আমলগুলো যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। এর বাইরে নিজেদের মনগড়া কোনো কিছু করা সম্পূর্ণ অনুচিত।
প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
Leave a Reply