হাইকোর্টে গত বৃহস্পতিবার কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আবারও জামিন না হওয়ায় বিএনপিতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বর্তমান নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে দল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে যে ধরনের আন্দোলন তৃণমূল থেকে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা বর্তমান নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ অবস্থায় যৌথ নেতৃত্বের পরিবর্তে নতুন নেতৃত্বে দল পরিচালনার তাগিদ উঠছে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে যৌথ নেতৃত্বে বিএনপি পরিচালিত হচ্ছে। এ নেতৃত্বে আছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। এই যৌথ নেতৃত্ব এ পর্যন্ত যেসব কর্মসূচি নিয়েছে তা সরকারকে কোনো অবস্থায় চাপে ফেলতে পারেনি। সরকার কোনো দাবি না মানলেও তাদের (সরকার) সঙ্গে নির্বাচনী সংলাপে অংশ নেওয়া, সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ, নির্বাচিতদের শপথ, উপনির্বাচন ও সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। যৌথ নেতৃত্বে এসব সিদ্ধান্ত নিলেও তৃণমূল ও মধ্যম সারির নেতারা ছাড়া স্থায়ী কমিটির অনেক নেতা এসব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিল।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, যৌথ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের কারণেই বারবার সরকার উপকৃত হয়েছে। বরং খালেদা জিয়া যেসবের বিরুদ্ধে ছিলেন বিএনপির বর্তমান যৌথ নেতৃত্ব সেসব বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ কারণেই আমাদের সিনিয়র নেতাদের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা সরকারের লোক হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছেন।
বর্তমানে বিএনপির নেতৃত্বে যারা আছেন, তাদের নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছেÑ এমন বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, এটা আমিও জানি। নতুন নেতৃত্বের বিষয়ে চিন্তা করবেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, সময় এলে সব জানতে পারবেন।
এ অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজউদ্দিন আহমেদ ঘোষণা করেছেনÑ ‘বিএনপির নেতারা যদি হুকুম না-ও দেন, তার পরও যারা এই সরকারের পতনের জন্য নামবে, আমি তাদের সঙ্গে থাকব।’
আন্দোলনের জন্য সৎ নেতৃত্ব প্রয়োজন উল্লেখ করে হাফিজউদ্দিন বলেন, যাদের প্রচুর টাকা, ধন-দৌলতের অভাব নেই, তারা কীভাবে আন্দোলন করবে? আন্দোলন করার জন্য শক্ত ও সৎ ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন। আজ যদি নেতারা ব্যর্থ হন, আমরা ব্যর্থ হই, আপনারা নামেন রাস্তায়। আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তিরা আছি আপনাদের সঙ্গে। বিএনপি যদি আন্দোলন না করে, অন্য কোনো দল যদি আন্দোলন করে, আমরা আছি শেখ হাসিনাকে সরাবার জন্য। আজ দেশবাসী আশা করে বিএনপি এ সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবে, দেশবাসী আশা করে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য বিএনপির প্রতিটি কর্মী রাজপথে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবেন। এ সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে চলে গেছে, আমাদের রাস্তায় নামতে হবে। খালেদা জিয়ার মতো নেত্রীর সাহসই আমাদের সাহস। আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তি। আমাদেরও একটু সাহস প্রদর্শন করতে হবে। তিনি বলেন, রাজপথে নেমেছি, আগামী দিনেও নামব।
হাফিজের এই ঘোষণা নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, তার এ বক্তব্যে দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মনে হয়েছে বিএনপি মানে স্থায়ী কমিটি নয়, বিএনপি মানে হচ্ছে খালেদা জিয়াÑ এটা স্থায়ী কমিটির অনেক নেতাই ভুলে গেছেন। জিয়াউর রহমানকে বাদ দিয়ে যেমন বিএনপি হবে না, তেমনি খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়েও বিএনপি হবে না। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি যদি আইনি প্রক্রিয়ায় সম্ভবপর না হয়, তা হলে আন্দোলন ছাড়া আমাদের অন্য কোনো বিকল্প নেই। এই আন্দোলন শুধু মুখে বললে চলবে নাÑ এটা কার্যকর করতে হবে। এমন কর্মসূচি দিতে হবে যে, কর্মসূচি আমরা দৃঢ়ভাবে পালন করতে পারব।
যুবদল-ছাত্রদলসহ অঙ্গ সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করা ছাড়া কার্যকর আন্দোলন সম্ভব নয় বলে মনে করেন দলের একাধিক স্থায়ী কমিটি ও ভাইস চেয়ারম্যান পর্যায়ের নেতা। তারা বলেন, খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর গত দেড় বছর ধরে বিএনপির নানা পর্যায় ও তার অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠনে কাজ করে আসছে। এ কাজে মূল নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসম্পাদকরা। এ ছাড়া ছাত্রদল ও যুবদল একাধিক টিম করে নানা জেলায় কাজ করছে।
তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, তৃণমূল পর্যায়ে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অবস্থা খুবই করুণ। কেন্দ্রীয় কমিটি বারবার পুনর্গঠন হলেও তৃণমূল পর্যায়ের কমিটিগুলো ঠুঁটো জগন্নাথ অবস্থা। বিএনপির জেলা ও মহানগরের কমিটিগুলো প্রভাবশালী নেতা-সাবেক এমপির লোক ছাড়া কেউই নেতৃত্বে আসতে পারেনি। ঢাকা মহনগরের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কার্যকর কোনো সংগঠনও নেই। সদ্য অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তার প্রমাণও হাতে হাতে পেয়েছে বিএনপি। ফলে পুনর্গঠনে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছতে পারেননি তারেক রহমানও। সম্প্রতি, স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এ পুনর্গঠন নিয়ে কথা উঠেছে। সেখানে তারেক রহমানকে বলা হয়েছেÑ যে প্রক্রিয়ায় পুনর্গঠন হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে তা কোনো দিনই শেষ হবে না। এতে দলের চেইন অব কমান্ড বলতে কিছুই থাকবে না।
কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে মওদুদ আহমদ বলেন, এজন্য আমাদের তরুণ সমাজ, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল; যারা সংগঠনে আছে তাদের যদি সংগঠিত করতে না পারি, তারা যদি আন্দোলন করতে না পারে, তা হলে আন্দোলন হবে না। আন্দোলন করতে হলে ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, সংগঠিত করতে হবে এবং তাদের ময়দানে নামতে হবে। মওদুদ আহমদ আরও বলেন, আমাদের নিরাশ হলে চলবে না। আমরা অনেক দেখেছি পৃথিবীতে অনেক দেশে কর্তৃত্ববাদ, স্বৈরাচার সরকারের আবির্ভাব ঘটেছে; কিন্তু তারা টেকেনি। এই সরকারও টিকবে না। যেতে হবেÑ এটা সময়ের ব্যাপার।
Leave a Reply