বাংলাদেশের মঞ্চ, টেলিভিশন ও রুপালি পর্দা কাঁপানো শক্তিমান অভিনেতাদের অন্যতম হুমায়ুন ফরীদি। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু অসাধারণ সৃষ্টিকর্মে হয়ে আছেন অমলিন। তিনি আছেন সবার হৃদয়ে। আজ চারদিকে রঙের ছড়াছড়ি। অথচ এসব রঙের মাঝে নেই একজন হুমায়ুন ফরীদি। আমাদের আজকের আয়োজন তার অভিনীত জনপ্রিয় ৫ সিনেমা ও ৫ নাটক নিয়ে। লিখেছেন- ফয়সাল আহমেদ
সিনেমা
দহন (১৯৮৫) : শেখ নিয়ামত আলীর চলচ্চিত্র দহন। একজন বেকার যুবক, যার ওপর পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে, প্রেমে পড়েন এক ধনীর আদুরে কন্যার। নিজের বেকারত্ব, সংসার, ভালোবাসা নিয়ে এক মানসিক টানাপড়েনে পড়া এই চরিত্রে হুমায়ুন ফরীদির অনবদ্য অভিনয় এখনো দর্শকদের মনে গেঁথে আছে। প্রথম ছবিতেই অর্জন করেন বাচসাস পুরস্কার, ছবিটি বিভিন্ন শাখায় জাতীয় পুরস্কারও অর্জন করে। দর্শক, সমালোচক সবার কাছেই এই সিনেমা সমান প্রিয়। এই সিনেমায় হুমায়ুন ফরীদির সহশিল্পী ছিলেন ববিতা, আসাদুজ্জামান নূর ও আবুল খায়ের।
ত্যাগ (১৯৯৩) : ‘তেল গেলে ফুরাইয়া বাত্তি যায় নিভিয়া’Ñ সৈয়দ আবদুল হাদীর কণ্ঠে ভাব্যিক এই জনপ্রিয় গানটির কথা মনে উঠলেই ভেসে ওঠে ‘ত্যাগ’ সিনেমায় ভয়ঙ্কর ভিলেন ইমেজের সেই হুমায়ুন ফরীদিকে। এই সিনেমায় অভিনয় করে তিনি সত্যিকার অর্থেই ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। বাণিজ্যিক ধারার ছবিতে শহিদুল ইসলাম খোকনের বাইরে যে কয়েকজন তাকে খুব ভালো ব্যবহার করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম এই সিনেমার নির্মাতা শিবলী সাদিক। এই সিনেমায় তিনি প্রধান খল চরিত্রে অভিনয় করেননি, নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের দ্বৈত চরিত্রে ছিলেন তবু নিজের প্রতিভায় সর্বাপেক্ষা আলোচিত হয়েছিলেন।
ঘাতক (১৯৯৪) : মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী প্রেক্ষাপট নিয়ে শহিদুল ইসলাম খোকনের সিনেমা ‘ঘাতক’। সিনেমার মূল শিল্পী শাবানা, আলমগীর, রুবেল, সোনিয়া। কিন্তু এদেরকে ছাপিয়ে সিনেমার অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠেন হুমায়ুন ফরীদি। রাজাকার গোলাম আযম থেকে অনুপ্রাণিত এই চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় সিনেমাটিকে বেশ জনপ্রিয় করে তোলে। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে খল হিসেবে এই চরিত্রটি অনেক জনপ্রিয়। এই চরিত্রের জন্য ছবিটিকে প্রথমে সেন্সর বোর্ড আটকে দিলেও, পরে অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়।
বিশ্বপ্রেমিক (১৯৯৫) : বাংলাদেশের প্রথম সাইকো থ্রিলার ছবি ‘বিশ্বপ্রেমিক’। পরিচালক শহিদুল ইসলাম খোকনের অন্যতম সেরা এই ছবিতে নাম ভূমিকায় সাইকো চরিত্রে অভিনয় করেন হুমায়ুন ফরীদি। সেই বছরের অন্যতম ব্যবসাসফল এ ছবি দিয়েই বাণিজ্যিক জগতে হুমায়ুন ফরীদি অনন্য হয়ে ওঠেন। এই সিনেমায় হুমায়ুন ফরীদির সহশিল্পী ছিলেন রুবেল, মৌসুমী ও সোহেল রানা।
মাতৃত্ব (২০০৪) : একজন গ্রাম্য চোর, অনেক দিন পর তার স্ত্রী মা হবেন। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর জমানো টাকার ওপর নজর পড়ে চোর স্বামীর। আর এই চরিত্রেই হুমায়ুন ফরীদি অভিনয় করেন জাহিদ হোসেনের মাতৃত্ব ছবিতে। অনবদ্য অভিনয়ে পুরো ছবিতে হুমায়ুন ফরীদিই হয়ে ওঠেন প্রধান আকর্ষণ। এই গুণী অভিনেতার একমাত্র জাতীয় পুরস্কার অর্জন এই সিনেমা দিয়েই। এই সিনেমায় তার স্ত্রীর ভূমিকায় ছিলেন মৌসুমী।
নাটক
ভাঙনের শব্দ শুনি (১৯৮৩) : সেলিম আল দীনের রচনায় নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর প্রযোজনায় ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ নাটকে গ্রাম্য মোড়ল সেরাজ তালুকদার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। বিটিভির ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত এই নাটকে খল চরিত্রে তার অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে। আরও অভিনয় করেছেন ফেরদৌসী মজুমদার, সুবর্ণা মুস্তাফা, হানিফ সংকেত, আবদুল্লাহ আল মামুন।
সংশপ্তক (১৯৮৮) : শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত আবদুল্লাহ আল মামুন ও আল মনসুরের প্রযোজনায় ধারাবাহিক নাটক ‘সংশপ্তক’-এ কানকাটা রমজান চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান ফরীদি। ইতিহাসনির্ভর এই গল্পে কুটিল নায়েব থেকে জমিদার বনে যাওয়া চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
অযাত্রা (১৯৮৭) : একজন গরিব অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক অবসর ভাতার জন্য ঢাকায় তার এক পরিচিতের বাসায় উঠেছিলেন। এই বাড়ির ছোট মেয়ে গান গেয়ে গাছে ফুল ফোটানোর চেষ্টা করে। দুজনের মধ্যে সখ্য হয়। ওই দিকে দুর্নীতির কারণে অবসর ভাতা পান না স্কুলশিক্ষক, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। হুমায়ূন আহমেদের জীবনঘনিষ্ঠ প্রতীকী এই নাটকে স্কুলশিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। সদ্য ত্রিশ পেরোনো একজন অভিনেতা কীভাবে নিজের অভিনয় গুণে ষাটোর্ধ্ব মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তা আশ্চর্য হওয়ার মতো। এই নাটকে আরও ছিলেন আবুল হায়াত, সারা যাকের ও লোপা।
শীতের পাখি (১৯৯১) : মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে পাড়ি জমানো এক যুবক অনেক দিন পর ফিরে আসে বাংলাদেশে। আসার পর দেখে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে, নিজের দেশে নিজেকে অতিথি মনে হতে থাকে তার, আত্মদহনে ভুগতে থাকেন। ফেরদৌস হাসানের রচনায় এই অনবদ্য নাটকে সেই যুবকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ফরীদি। এ ছাড়া ছিলেন গোলাম মুস্তাফা, ফেরদৌসী মজুমদার, শম্পা রেজা, খালেদ খান।
অচিন বৃক্ষ (১৯৯২) : গ্রামের একজন সাধারণ সহজ সরল শিক্ষক তিনি, গ্রামে অচিন বৃক্ষ দেখতে আসবেন একজন বিখ্যাত লেখক। এই নিয়ে তার অনেক উচ্ছ্বাস। ঐ দিকে স্ত্রী খুব অসুস্থ, টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারছেন না। অচিন বৃক্ষে ফুল ফুটবে, সে ফুল দিয়ে স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠবে এটাই তার বিশ্বাস। এই বিশ্বাস, আশা নিয়েই হুমায়ূন আহমেদের নাটক ‘অচিন বৃক্ষ’। সহজ সরল স্কুলশিক্ষকের ভূমিকায় ফরীদির মায়াভরা অভিনয় দেখে বোঝার উপায় নেই তিনিই আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় খল অভিনেতা। দারুণ এই নাটকে তার সহশিল্পী ছিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা, আলী যাকের, আবুল হায়াত, শীলা আহমেদ।
Leave a Reply