যেকোনো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে গ্রাহককে ৮ থেকে ১০ পাতার একটি ফরমে ডজন খানেকের বেশি স্বাক্ষর করতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ গ্রাহক কখনো ওই ফরমে কী লেখা রয়েছে, হিসাব পরিচালনার জন্য ব্যাংক থেকে কী কী শর্ত দেয়া রয়েছে, গ্রাহকের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো শর্ত রয়েছে কী না তা কখনো পড়ে দেখেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষার শর্তই বেশি থাকে। অ্যাকাউন্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যার উদ্ভব হলে বা গ্রাহকের স্বার্থপরিপন্থী কোনো সমস্যা দেখা দিলে তখনই গ্রাহক বুঝতে পারেন তিনি কোন কোন শর্ত মেনে হিসাব খোলার ফরমে স্বাক্ষর করেছিলেন। এভাবে অজান্তেই গ্রাহক আটকে যান। এছাড়া বছরের বিভিন্ন সময় গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে কাটা হয় সার্ভিস চার্জের নামে নানা ধরনের মাশুল।
রফিক হাসান নামে একজন গ্রাহক দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তিনি সমুদয় টাকা পরিশোধ করে দেন। ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী তার সব অর্থ পরিশোধ করার পর ব্যাংক থেকে ঋণ পরিশোধের অনাপত্তি প্রত্যায়নপত্র নিতে যান তিনি। কিন্তু ব্যাংক থেকে বলা হয়, তার আরো বাড়তি ৩৫ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। শাখা ব্যবস্থাপকের কাছে কারণ জানতে চাইলে জানানো হলো, তিনি ঋণ নেয়ার সময় যে ফরমে স্বাক্ষর করেছিলেন, ওই ফরমেই একটি শর্ত ছিল, নির্ধারিত সময়ের আগে ঋণ পরিশোধ করা হলে অগ্রিম সার্ভিস চার্জ হিসাবে ঋণের ২ শতাংশ অর্থ বাড়তি পরিশোধ করতে হবে। রফিক হাসান আক্ষেপ করে জানান, বড় বড় শিল্প উদ্যোক্তারা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেন না। ব্যাংকের খাতায় ঋণখেলাপি হিসেবে নাম লেখান। ব্যাংক এর জন্য নানা সমস্যায় পড়ে। যেমন, খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের আয় থেকে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এতে ব্যাংকের আয় কমে যায়। কিন্তু তিনি নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ঋণ পরিশোধ করেছেন। এতে ব্যাংক থেকে তাকে পুরস্কার দেয়ার কথা, সেখানে উল্টো জরিমানা গুনতে হয়েছে। রফিক হাসান ঋণপত্রে শুধু স্বাক্ষরই করেছেন, কিন্তু ওই ঋণপত্রে নিজের স্বার্থপরিপন্থী কোনো শর্ত রয়েছে কী না, তা পড়ে দেখেননি। এরই ফল ভোগ করেছেন অগ্রিম ঋণ পরিশোধের পর পুরস্কারের পরিবর্তে জরিমানার মাধ্যমে।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ফরমে জটিলতা : এই ভুলটা শুধু সাধারণ গ্রাহকই নন, উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিরাও করে থাকেন। বেশ কয়েক বছর আগে একজন জাদরেল আমলাও একই ভুল করেছিলেন। বড় মাপের ওই ডাকসাইটের সাবেক সচিব একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অবসরকালীন ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু লোকসান হওয়ায় তিনি এককালীন ঋণ পরিশোধ করে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে গিয়েছিলেন। এতে তাকে দিন শেষে বড় অঙ্কের জরিমানা গুনতে হয়েছিল শর্তের বেড়াজালে পড়ে।
শুধু ঋণের হিসাবের ক্ষেত্রেই নয়, আমানতের হিসাবের ক্ষেত্রেও একই তিক্ত অভিজ্ঞতার তথ্য পাওয়া যায় গ্রাহকের কাছ থেকে। নির্ধারিত মেয়াদের আগেই কেউ বিভিন্ন মেয়াদি আমানতের হিসাব বন্ধ করতে গিয়ে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হতে দেখা যায়। যেমন, কেউ প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে ১০ বছর মেয়াদি একটি মেয়াদি আমানত খুললেন। টানা ছয় বছর প্রতি মাসেই যথাসময়ে আমানত জামা দিয়েছেন। সংসারের অতি প্রয়োজন মেটাতে বা আয় কমে যাওয়ায় কিস্তি চালাতে অপারগতার কারণে হিসাব বন্ধ করতে গেলেন। দেখা গেলো, নানা শর্তের বেড়াজালে ফেলে ওই গ্রাহক তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হন।
এত গেলো হিসাব বন্ধ করার অংশ, হিসাব পরিচালনার ক্ষেত্রেও গ্রাহককে না জানিয়েই বছরের মাঝামাঝি ও শেষ হওয়ার দিন গ্রাহকের মোবাইলে নানা এসএমএস আসতে থাকে। হিসাব পরিচালনা ফি, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ফি, আবগারি শুল্কসহ নানা ফির নামে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ কাটা হয়। কেউ এর প্রতিবাদও করতে পারেন না। কারণ তিনি তো অ্যাকাউন্ট খোলার সময়ই ডজন খানেকেরও বেশি জায়গায় স্বাক্ষর করেছেন না পড়ে বা বুঝে। এ কারণে কেউ প্রতিবাদ করেও এর কোনো সুফল পাবেন না।
প্রতি বছরের শেষ দিন বা তার আগের দিন গ্রাহকের কাছে নানা এসএমএস আসে তার হিসাব থেকে অর্থ কাটার। কখনো একসাইজ ডিউটি বা আবগারি শুল্ক নামে, ডেবিট ট্যাক্স ডিডাকশন এবং মোবাইল সার্ভিস চার্জ নামেও গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ কেটে রাখা হয়। অনেকেই উৎসুক হন, জানতে চান কী কারণে তার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কাটা হচ্ছে। এ বিষয়ে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সাধারণত প্রতি বছর জুনে ও ডিসেম্বরের শেষে নানা সার্ভিস চার্জ কাটা হয়। যেমন, সরকারের কোষাগারে জমা দেয়ার জন্য আবগারি শুল্ক ও মুনাফার ওপর কর কাটা হয়। সাধারণত কোনো গ্রাহকের কর শনাক্তকারী নম্বর বা টিআইএন থাকলে তার মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ এবং টিআইএন না থাকলে ১৫ শতাংশ কর কাটা হয়। আর অ্যাকাউন্টে অর্থের পরিমাণ থাকা সাপেক্ষে বিভিন্ন অঙ্কের আবগারি শুল্ক কাটা হয়। কোনো গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে এক লাখ থাকলে তার আবগারি শুল্ক দিতে হয় না। তবে এক লাখ টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা থাকলে ১৫০ টাকা আবগারি শুল্ক কাটা হয়। আর ১০ লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক কাটা হয় তিন হাজার টাকা। যদি কোনো গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে বছরের যেকোনো সময়ে ১০ লাখ টাকা থাকে তাহলেও ওই গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে তিন হাজার টাকা কাটা হয়। এর বাইরে অ্যাকাউন্ট পরিচালনা ফি ও মোবাইলের এসএমএস ফি কাটা হয়। তবে অ্যাকাউন্ট খোলার ফরমে যেসব শর্ত থাকে তার মধ্যে মোবাইল এসএসএম চান কি না এমন শর্ত থাকে। আর মোবাইল এসএমএস চাইলে আলাদা ফি কাটা হবে। এর একটি অংশ মোবাইল কোম্পানিগুলো ও আরেকটি অংশ ব্যাংক পেয়ে থাকে। বেশির ভাগ গ্রাহকই হিসাব খোলার ফরম ভালোভাবে না পড়ে স্বাক্ষর করেন। আর এ কারণেই তার অ্যাকাউন্ট থেকে বছরে দুইবার সার্ভিস চার্জের নামে অর্থ কেটে রাখা হয়।
Leave a Reply