বিদায়ী বছর ২০২১ বিশেষ কয়েকটি কারণে মানুষের মনে থাকবে। এরমধ্যে নিত্যপণ্য নিয়ে ভোগান্তি ছিল অন্যতম। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে মানুষের আয় যখন কমছিল তখন লাগামহীন হয়ে ওঠে নিত্যপণ্যের দাম। বাজারে পণ্যের ঘাটতি না থাকলেও সিন্ডিকেট চক্র কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বারবার দাম বাড়িয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার পণ্যের শুল্ক কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও ফলাফল উল্টো হয়েছে। অথচ দেশে খাদ্য উৎপাদন আগের তুলনায় বেড়েছে। ন্যায্যমূল্যে খাদ্য পেতে মানুষ দীর্ঘ লাইন ধরেছে টিসিবির ট্রাকের সামনে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে জড়িত ছিল অসাধু চক্র। ব্যবসায়ীদের অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম।
সিন্ডিকেটের ফলে নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে জনসাধারণ উচ্চমূল্যের কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। চাল, চিনি, ভোজ্য তেল, গুঁড়া দুধ, ইলিশ মাছ, মাংস, ডাল ও শাক-সবজির দাম বৃদ্ধিতে সিন্ডিকেট এখনো কাজ করছে বলে মনে করেন তারা।
সরকারের তথ্য বলছে, এ বছর বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি টনের বেশি, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। একই সময়ে মোট চাল উৎপাদিত হয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন, গম ১২ লাখ টন, ভুট্টা প্রায় ৫৭ লাখ টন, আলু ১ কোটি ৬ লাখ টন, শাক-সবজি ১ কোটি ৯৭ লাখ টন, পিয়াজ ৩৩ লাখ টন, তেল জাতীয় ফসল ১২ লাখ টন ও ডাল জাতীয় ফসল ৯ লাখ টন। সবমিলে দেশের এ বছর মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন দাঁড়িয়েছিল ৪ কোটি ৫৩ লাখ টনে। উৎপাদন বেড়েছে সার্বিকভাবে গড়ে ৩ শতাংশ হারে। এমনকি আলু, মাছ, মাংস ও ডিমের উৎপাদনও ছিল উদ্বৃত্ত। তারপরও সারা বছর ক্রমাগত বেড়েছে দাম।
জানা গেছে, বছরজুড়ে অস্থির ছিল পিয়াজের দাম। অক্টোবরে পিয়াজের দাম কেজি প্রতি বেড়ে ৮০ থেকে ৯০ টাকায় ওঠে। বাজারে দাম স্বাভাবিক রাখতে পিয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। ফলে পিয়াজের দাম কিছুটা কমে যায়। ঊর্ধ্বমুখী ছিল চাল, ডাল, তেল, লবণ, শাক-সবজি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্যের দামও। বছরজুড়ে অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির। পাকিস্তানি কক বা সোনালি মুরগি, লাল লেয়ার মুরগির দামও ছিল বেশি। চালের দাম কেজি প্রতি ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দেয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এক বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৬ শতাংশ পর্যন্ত। পাশাপাশি আটা ও ময়দার ২৪ থেকে ৩৬ শতাংশ, সয়াবিন তেলের দাম ৪৯ শতাংশ, পামের ৫০ শতাংশ, ডাল ২৭ শতাংশ এবং পিয়াজের দাম ৪১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বছর শেষে সংস্থাটির তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, প্রায় ৩৪ ধরনের খাদ্যপণ্যের মধ্যে বছরের ব্যবধানে দাম কমেছে মাত্র ৮টির। ফলে ২০২১ সালের সারা বছরজুড়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতায় কেটেছে দেশ। এতে করোনায় বিপর্যস্ত মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ বছরেই অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। আবার চাকরি থাকলেও বেতন কমেছে অনেকের। ভালো ছিলেন না ব্যবসায়ীরাও।
টিসিবি’র মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ন্যায্যমূল্যে পণ্য কেনার চাহিদা বেশি। ট্রাকগুলোতে ক্রেতাদের বাড়তি ভিড় থাকায় পণ্যের পরিমাণও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ট্রাকের সংখ্যাও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
হঠাৎ করে চিনির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে লাগাম টানতে সেপ্টেম্বরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খোলা চিনির দাম প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৭৪ টাকা এবং প্যাকেট জাত চিনি প্রতি কেজি ৭৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে দাম কার্যকর করা যায়নি। দোকানে খোলা চিনি ৮০ এবং প্যাকেট জাত চিনি ৮৫ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।
একই ঘটনা ঘটেছে ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রেও। চলতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সাত দফা বাড়ানো হয় ভোজ্য তেলের দাম। বিশ্ব বাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে উল্টো বেড়েছে।
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড গড়ে সয়াবিন তেল। এখন খুচরায় বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগের দর ছিল ১৫৩ টাকা। এ ছাড়া পাঁচ লিটারের এক বোতল তেল পাওয়া যাবে ৭৬০ টাকায়, যা এতদিন ৭২৮ টাকা ছিল। এ ছাড়া খোলা সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ১৩৬ টাকা ও বোতলজাত পাম সুপার তেল ১১৮ টাকা দরে কিনতে পারবেন ক্রেতারা।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসে তেলের দাম নির্ধারণ করে দিলেও বাজারে সেই দাম কার্যকর হয়নি। বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে তেল। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে দাম নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে।
প্রতি মাসেই কোটি কোটি টাকার চাল আমদানি করা হচ্ছে। তবুও চালের দাম কমছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চাল আমদানিতে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। জুলাই থেকে নভেম্বর-এ পাঁচ মাসে চাল আমদানির এলসি খোলার হার বেড়েছে ১৩ হাজার ৭৭৯ শতাংশ। এলসি নিষ্পত্তির হার বেড়েছে ১৮ হাজার ৮১৮ শতাংশ। ২০২১ সালের একই সময়ে এলসি খোলা হয় ৩২ কোটি ৫ লাখ ডলারের। বর্তমানে বাজারে পাইকারিতেই মোটা চালের কেজি ৪২ টাকা, বিআর-২৮ চাল ৪৭ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৬ টাকায়। ৫৬ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া মিনিকেটের দাম কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে এখন ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, দেশের বিভিন্ন খাতে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান কৃষিখাত। দীর্ঘসময় ধরেই এ খাত ভালো করছে। তারপরও উৎপাদনের সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না কিছু জায়গায় অব্যবস্থাপনার কারণে। অনেক সময় সে সাফল্য পুরোটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে যখন নিত্যপণ্যের জোগান আর দৃশ্যমান থাকছে না। দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার দুষ্টচক্রের কবলে পড়েছে। ভোক্তাদের জিম্মি করে এসব দুষ্ট ব্যবসায়ী নানা ধরনের সুবিধা নিচ্ছে।
Leave a Reply