চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও তার ভাইদের নিয়ে একটি অনুসন্ধানী তথ্যচিত্র প্রকাশ করে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। এ নিয়ে তখন তোলপাড় হয় বাংলাদেশে। এই তথ্যচিত্র প্রকাশের পর শুরুতে বিব্রত হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন আজিজ আহমেদ। সেই সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে থাকলেও সেখানে এর কোনো প্রভাব পড়েনি বলে দাবি করেছেন। গত শুক্রবার রাতে ডয়চে ভেলের ‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ অনুষ্ঠানে তিনি এ দাবি করেন।
এক ঘণ্টার এই আলোচনায় ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ মুহিউদ্দীনের নানা প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে উঠে এসেছে আল জাজিরার তথ্যচিত্র, ভাইদের বিষয়ে নানা অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা বাতিল, নির্বাচনের সেনাবাহিনীর ভূমিকাসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ। আল জাজিরার তথ্যচিত্রে অভিযোগ করা হয়েছিল, ইসরায়েল থেকে
স্পাইওয়্যার ও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ক্রয় প্রক্রিয়ায় জেনারেল আজিজ প্রভাব খাটিয়েছেন। এর উত্তরে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, কেনাকাটাগুলো যখন হয় তখন সেনাপ্রধান হিসেবে এর সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। যদিও তিনি দায়িত্ব নেওয়ার একদিন পর নজরদারি প্রযুক্তি ক্রয়ের স্বাক্ষর হয়। তিনি দাবি করেন, প্রক্রিয়াগুলো আগেই সম্পন্ন হয়েছিল।
আজিজ আহমেদ বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করছি কেউ যদি কোনো একটা ‘এভিডেন্স’ দিতে পারে যে আমি বিজিবিতে থাকাকালে, আমি সেনাপ্রধান থাকাকালীন আমার কোনো ভাই বা আত্মীয়কে বিজিবি বা সেনাবাহিনীর কোনো ‘আর্মস, ইকুয়েপমেন্ট, অ্যামুনেশন প্রক্রিউরম্যান্ট, কন্ট্রাক্ট’ দিয়েছি- এটা যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে ‘আই উইল অ্যাকসেপ্ট অ্যানিথিং। আই অ্যাম রেডি। আই এম গিভিং এ চ্যালেঞ্জ।’
যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা বাতিলের খবর : সম্প্রতি বাংলাদেশে কিছু গণমাধ্যমের সংবাদে বলা হয়েছিল- সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভিসা বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। শুরুতেই এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল তার কাছে। সরাসরি তা অস্বীকার করে সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, তিনিও গণমাধ্যমে এই সংবাদ শুনেছেন। যুক্তরাষ্ট্র কারও ভিসা বাতিল করলে তাকে তা জানানোর বিধান আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য দেশটির কোনো দায়িত্বশীল দপ্তরের কাছ থেকে পাননি। গণমাধ্যমগুলো যথাযথ সূত্র ও তথ্য-প্রমাণ উল্লেখ না করেই এ বিষয়ে প্রতিবেদন ছাপিয়েছে বলে তার অভিযোগ। এই মুহূর্তে তার বৈধ ভিসা আছে কিনা এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি, আছে।’
‘এক-দুই কোটি টাকা দেখান’ : তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক কিনা- এমন প্রশ্ন করেন সঞ্চালক। জবাবে আজিজ আহমেদ বলেন, ‘কয়েকশ কোটি নয়, আমাকে সামান্য কিছুর সূত্র দিন যাতে বাকি জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাতে পারি। শত শত কোটি নয় যদি… বলতে পারেন লাখ লাখ বা এক-দুই কোটি টাকা আছে, তা হলে ওটা দিয়ে আমি পরিকল্পনা করব আমার ভবিষ্যৎটা স্বাচ্ছন্দ্য হতে পারে কিনা।’ এ ধরনের অভিযোগকে তিনি মনগড়া হিসেবে অভিহিত করেন।
অবসর জীবন নিয়ে সাবেক এ সেনাপ্রধান বলেন, ‘রিটায়ারম্যান্টের পরে তিনি এখন দায়িত্বের চাপ থেকে মুক্ত। এই মুহূর্তে পোস্ট ডক্টরাল করছেন তিনি, সেই বিষয়ে গবেষণা করেই সময় কাটাচ্ছেন।’
ব্যক্তিগত সহকারীর ‘পদচ্যুতি’ : সেনাপ্রধানের দায়িত্ব ছাড়ার পরপরই তার ব্যক্তিগত সহকারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় বলে খবর বের হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশে ১৬তম সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, আমি যখন রিটায়ারম্যান্টে আসি তখন শুনেছি। সে অবসরে গিয়েছে।… ডিসিপ্লিন বলে একটা কথা আছে। দুর্নীতির বিষয়টি আরও গভীর।… অত সিরিয়াস যদি কোনো কিছু হতো ‘হি শুড হ্যাভ বিন ডিসক্লোজড ফ্রম দ্য সার্ভিস’। সেক্ষেত্রে আমরা অনেককে জেল দিয়ে থাকি, অনেককে বরখাস্ত করে থাকি। ‘হি ওয়াজ গিভেন নরম্যাল রিটায়ারম্যান্ট’। আমি এ ব্যাপারে ‘ফারদার’ কিছু বলতে চাচ্ছি না।’
ভাইদের জাতীয় পরিচয়পত্র : বাংলাদেশে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, জেনারেল আজিজের দুই ভাই হারিছ আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ নতুন নাম আর ভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন। এ বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, ‘কত লাখ লাখ বাংলাদেশি লোকজন বিদেশে আছে তাদের কি নিজস্ব নাম পিতৃপরিচয় বা ঠিকানা কি একচুয়েলটা ইউস করছে?’
নাম-পরিচয় পরিবর্তনে তিনি প্রভাব খাটিয়েছিলেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘একটা উদাহরণ দেন কোনো জায়গায় আমি কাউকে টেলিফোন করেছি কিনা, যে আপনি একে নির্দেশ দিয়েছেন যে এটা করে দেও। এ রকম কোনো এভিডেন্স কি আপনাদের কাছে আছে? প্রমাণ দেন।’
আবেদনপত্রের কোনো পর্যায়ে তার অধীন কোনো বিজিবি অফিসার যুক্ত ছিলেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো কিছু হয়েছে কিনা আমার কিছু জানা নেই। আর এ ধরনের স্বাক্ষর করার প্রসঙ্গ এসেছিল কিনা আমার ঠিক মনে পড়ছে না।’
কোর্সমেটের সঙ্গে ফোনালাপ : আল জাজিরার তথ্যচিত্রে জেনারেল আজিজ ও তার একজন কোর্সমেটের কথোপকথন ফাঁস করা হয়। এ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে আজিজ আহমেদ দাবি করেন অডিওটি সঠিক নয়। তিনি বলেন, ‘ইট ওয়াজ এ কাট অ্যান্ড পেস্ট। ইট ওয়াজ টেম্পার্ড। …অনেক কিছু করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। বলেন, ‘এতদিন আমি ইউনিফর্মে ছিলাম, এটার ব্যাপারে যদি আমি কোনো লিগ্যাল অ্যাকশনের বা ব্যবস্থা নিতাম অনেকে প্রশ্ন করত যে আই এম এক্সারসাইজিং মাই অথরিটি। আই এম মিসইউজিং মাই পাওয়ার। আমি কিন্তু এখন ইউনিফর্মের বাইরে আসছি। আগামী জুনের ২৫ তারিখের পর আমার সম্পূর্ণ রিটায়ারম্যান্ট শুরু হবে। তখন আমি চিন্তা করব হোয়াট কাইন্ড অব লিগ্যাল অ্যাকশন আই শুড টেক এগেইন্সট দিস কাইন্ড অব প্রপাগান্ডা অ্যান্ড আদার থিংস। ’
নির্বাচন প্রসঙ্গ : দেশের সবশেষ জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন করা হয় তাকে। জবাবে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী কী দায়িত্ব পালন করবে তার পরিষ্কার নির্দেশনা ছিল। তিনি বলেন, চাইলেই সেনাবাহিনীর যা খুশি করার এখতিয়ার নাই। নির্বাচন কেমন হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় ভালো নির্বাচন হয়েছে।
Leave a Reply