স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী চলতি মাসের ২৫ তারিখে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন রুবাইয়াত হোসেন। তার ঠিকানা লেখা রয়েছে রাজধানীর বকসিবাজার এলাকার। ওই ঠিকানায় দেখা গেছে রুবাইয়াত হোসেন নামের কেউ থাকেন না। ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে জানা গেল ব্যক্তিটির নাম শফিকুল ইসলাম। তিনি কখনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হননি। এমনকি তিনি কখনই বকসিবাজার এলাকায় ছিলেন না। স্থায়ীভাবে বসবাস করেন সাতক্ষীরা জেলায়। কেবল শফিকুল ইসলামই নন, এমন অসংখ্য ব্যক্তি রয়েছেনÑ যাদের ডেঙ্গু রোগী বলা হলেও আদতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হননি। আবার অনেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও তাদের নাম নেই তালিকায়। আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন অনেক বিস্ময়কর তথ্য।
শুধু তথ্যে গরমিলই নয়, রয়েছে আরও অনেক বিভ্রাট। ২৮ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে আক্রান্তদের যে তালিকা পাঠানো হয় তাতে বলা হয়, সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ২৬৫ জন।
একই দিনে গণমাধ্যমে পাঠানো তথ্যে বলা হয়, আক্রান্তের সংখ্যা ২৯৫ জন। অর্থাৎ সরকারি হিসাবেই রোগীর সংখ্যার পার্থক্য ৩০ জন।
চলতি মাসের ৯ তারিখ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত ২০ দিনের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বাড়ছে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায়। ডেঞ্জার জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন টঙ্গী এলাকা। ২০ দিনের তথ্য বিশ্লেষণে গাজীপুরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৪২১ জন। এর মধ্যে কেবল টঙ্গীতেই আক্রান্তের সংখ্যা ৩৮৫। গত ১৬ আগস্ট আক্রান্ত হয় ৩৬, ১৯ আগস্ট ২৯, ২৫ আগস্ট ৪২, ২৬ আগস্ট ৩০ জন। ২৮ আগস্টেও আক্রান্ত হয় ৩৪ জন। কেবল ২০ দিনেই আক্রান্তের সংখ্যা ৩৮৬ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে গণমাধ্যমের কাছে পাঠানো ২০ দিনের তথ্য অনুসারে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৪ হাজার ৯৩৬ জন। তবে সিটি করপোরেশনগুলোর কাছে পাঠানো তথ্য অনুসারে এ সংখ্যা ৪ হাজার ২০৮ জন। ৪ হাজার ২০৮ জনের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এলাকায় আক্রান্ত রোগী রয়েছে ১ হাজার ৪৯৪, ঢাকার বাইরে রয়েছে ৯৩১ জন। গত ২০ দিনে ঢাকার বাইরেই আক্রান্তের হার ২২.১২ শতাংশ। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় আক্রান্তের হার ৩৫.৫০ শতাংশ। মাত্র ২০ দিনের হিসাবেই গণমাধ্যমে প্রেরিত রোগীর সংখ্যার সঙ্গে করপোরেশনে পাঠানো রোগীর সংখ্যার পার্থক্য ৭২৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় অসঙ্গতির বিষয়টি স্বীকার করছে সিটি করপোরেশনও। এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের দায়িত্বশীল ও যথাযথ অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা গেলেই কার্যকরভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিটি করপোরেশনসহ সব অংশীজনের ডেঙ্গু রোগীর তালিকা দেওয়া থাকে। তালিকা অনুযায়ী ডেঙ্গু রোগীর আবাসস্থলসহ চারপাশে এডিস মশার উৎসস্থল নিধন করা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সরবরাহ করা অসম্পূর্ণ তালিকা এবং তাতে নানা ধরনের অসঙ্গতি আমাদের কার্যক্রমকে বেশ দুরূহ করে তুলছে। পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ তালিকা সরবরাহের জন্য আমরা বারবার অনুরোধ করেছি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ড. নাজমুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, রোগী হাসপাতালে যে নাম-ঠিকানা দেয় সেভাবেই লেখা হয়। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। অনেক ক্ষেত্রে রোগী ঠিকানা অসম্পূর্ণ দেয়, এ জন্য ঠিকানায় গিয়ে রোগীকে হয়তো পাওয়া যায় না।
গণমাধ্যম ও সিটি করপোরেশনে পাঠানো রোগীর তালিকায় তারতম্যের বিষয়ে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এমআইএসকে যে ধরনের তথ্য দেয়, আমরা সেভাবেই বিভিন্ন করপোরেশনে পাঠাই। এর বাইরে কিছু জানা নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় এমন অনেকেই আছেন যারা আদৌ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হননি। আবার উল্টোটাও রয়েছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েও অনেকে তালিকায় যুক্ত হননি। ফলে ডেঙ্গুর আসল চিত্র জানা যাচ্ছে না।
জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোন হাসপাতালে কতজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়, এমন তালিকা পাঠায় গণমাধ্যমে। সেই তালিকায় নাম নেই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে। তবে রাজধানীর জুরাইন এলাকার চারজন রোগীর সংখ্যা কথা বলে জানা গেছে যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে। তাদের মধ্যে একজন পূর্ব জুরাইন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চলতি মাসের ৭ তারিখ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত চিকিৎসা নেন ন্যাশনাল মেডিক্যালে। একই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেন মিজানুর রহমানের ভাই মফিজুল ইসলাম। মিজানুর রহমান বা মফিজুল ইসলামই নন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এমন অনেকেই চিকিৎসা নিয়েছেন বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে। তাদের নাম নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায়। ফলে দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আসলে কতটুকু, তা আঁচ করা যাচ্ছে না বলে অভিমত নাগরিকদের। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডেঙ্গু আক্রান্তরা। গত সপ্তাহে জুরাইনের আদ-দ্বীন হাসপাতাল, ডক্টরস, মেডিবাংলা, দেশবাংলা, রয়েল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায় ডেঙ্গু আক্রান্তরা চিকিৎসা নিচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২৫ আগস্টের তালিকায় থাকা মীম নামের একজনকে ডেঙ্গু আক্রান্ত বলা হয়েছে। ফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জ¦র এসেছিল। শিকদার মেডিক্যালে ডেঙ্গু আক্রান্তের কথা বললেও মিটফোর্ড হাসপাতালে পরীক্ষার পরে জানা গেছে ডেঙ্গু নেই। ডেঙ্গু রিপোর্ট ছিল নেগেটিভ।
ডেঙ্গু আক্রান্তের তালিকায় থাকা মাস্টার নাবিল নামের একজন জানান, তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হননি। জ¦র থাকলেও ডেঙ্গু নেগেটিভ ছিল।
১৩ আগস্টের তালিকায় তাসলিমা আক্তার নামের একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে খবর নিয়ে জানা গেছে আদতে তাসলিমা আক্তার ডেঙ্গু আক্রান্ত হননি। শঙ্করের ইবনে সিনা হাসপাতালে তিনি সন্তান জন্মদান করেছিলেন। তালিকার গরমিল কেবল একদিনের নয়, চলতি মাসের ৯ তারিখ থেকে শুরু করে ২৮ তারিখ পর্যন্ত পাঠানো রোগীর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে প্রায় প্রতিদিনই গরমিল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে ৯ আগস্ট গণমাধ্যমে পাঠানো তালিকায় রোগীর সংখ্যা ২১০, করপোরেশনে পাঠানো তালিকায় ১৬৬ জন। ১০ আগস্ট গণমাধ্যমে ২২৬, করপোরেশনের তালিকায় ১৭৩ জন। ১১ আগস্টে গণমাধ্যমে ২১৩, করপোরেশনে ১২১ জন। ১২ আগস্ট গণমাধ্যমে ২৪২, করপোরেশনে ৩০৩ জন। ১৩ আগস্টে গণমাধ্যমে ২১১, করপোরেশনে ৬৯ জন। ১৪ আগস্টে গণমাধ্যমে ২৫৭, করপোরেশনে ৩০২ জন। ১৫ আগস্টে গণমাধ্যমে ১৯৮, করপোরেশনে ৭০ জন। ১৬ আগস্টে গণমাধ্যমে ২২১, করপোরেশনে ২৪১ জন। ১৭ আগস্টে গণমাধ্যমে ৩২৯, করপোরেশনে ৩৩২ জন। ১৮ আগস্ট গণমাধ্যমে ৩০৬, করপোরেশনে ২৭৮ জন। ১৯ আগস্টে গণমাধ্যমে ২৭০, করপোরেশনে ২১০ জন। ২০ আগস্টে গণমাধ্যমে ২২১, করপোরেশনে ৭৭ জন। ২১ আগস্টে গণমাধ্যমে ২৭৮, করপোরেশনে ৩১৮ জন। ২২ আগস্টে গণমাধ্যমে ২২৬, করপোরেশনে ২৩৭ জন। ২৩ আগস্টে গণমাধ্যমে ২৭৬, করপোরেশনে ১৯৩ জন। ২৪ আগস্টে গণমাধ্যমে ২৫৮, করপোরেশনে ২৪১ জন। ২৫ আগস্টে গণমাধ্যমে ২৭৮, করপোরেশনে ২৬৪ জন। ২৬ আগস্টে গণমাধ্যমে ২৬৭, করপোরেশনে ২৫২ জন। ২৭ আগস্টে গণমাধ্যমে ১৮৪, করপোরেশনে ৬৬ জন। ২৮ আগস্টে গণমাধ্যমে ২৬৫, করপোরেশনে পাঠানো তালিকা অনুসারে রোগীর সংখ্যা ২৯৫ জন। তবে গণমাধ্যমে পাঠানো তালিকার সঙ্গে করপোরেশনে পাঠানো তালিকার মধ্যে ঢাকার বাইরের রোগীর সংখ্যায় রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। গণমাধ্যমের তালিকায় গত ১২ আগস্টে ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা বলা হয় ২১ জন। তবে করপোরেশনে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে তাতে বলা হয়, ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা ৬৯ জন। প্রায় প্রতিদিনই রয়েছে এমন পার্থক্য।
এদিকে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নির্ধারণ (ডেডিকেটেড) করে দেওয়া হয়েছে রাজধানীর পাঁচটি সরকারি হাসপাতাল। ঢাকার বাইরে টঙ্গীতেও একটি হাসপাতালকে কোভিড ডেডিকেটেড করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল ছাড়া রাজধানীর বাকি চারটি হাসপাতালে এখনো সেবা শুরু করতে পারেনি। এসব হাসপাতালে রোগী এলে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় ২৩ আগস্ট রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, কমলাপুরের রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, আমিনবাজারের ২০ শয্যা হাসপাতাল, মিরপুর মাজার রোডের লালকুঠি হাসপাতাল ও কামরাঙ্গীরচরের ৩১ শয্যার হাসপাতালÑ এই পাঁচটি হাসপাতালকে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এর মধ্যে চারটিতেই রোগী ভর্তি না করায় চাপ বেড়েছে মিটফোর্ড হাসপাতালে। মিটফোর্ড হাসপাতালের ডেঙ্গু ইউনিটে শয্যা আছে ৮০টি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের হিসাব অনুযায়ী এখন রোগী ভর্তি আছেন ১৭৯ জন। গতকালই নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে ৪৭ জন। সর্বমোট এ হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৬৫৬ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ও ডেঙ্গু ইউনিটের ফোকাল পারসন মিজানুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি।
এদিকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড বাকি চারটি হাসপাতালে এখনো চিকিৎসাসেবা শুরুই করতে পারেনি। ফলে বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ঝুঁকছে আক্রান্তরা। যদিও এসব রোগীর বেশিরভাগই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকাল প্রকাশিত ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা হাসপাতালের তালিকায়ও কমলাপুরের রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, আমিনবাজারের ২০ শয্যা হাসপাতাল, মিরপুর মাজার রোডের লালকুঠি হাসপাতাল ও কামরাঙ্গীরচরের ৩১ শয্যার হাসপাতালের নাম ছিল না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কামরাঙ্গীরচরের ৩১ শয্যার হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সোহেলী শারমিন কথা বলতে চাননি।
ঢাকার বাইরে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালকেও ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে অধিদপ্তরের প্রকাশিত তালিকায় এ হাসপাতালটিতেও রোগী ভর্তির তথ্য নেই।
Leave a Reply