জালিয়াতির মাধ্যমে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার বিচার শেষপর্যায়ে। মামলার ২১ সাক্ষীর মধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। শেষ সাক্ষী মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদক পরিচালক বেনজির আহমেদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। জেরা শেষ হলেই যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণা হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাবেক প্রধান বিচারপতির সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদ- হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মামলার বিচার পরিচালনায় নিয়োজিত দুদকের আইনজীবী বিশেষ পিপি মীর আহম্মেদ আলী সালাম আমাদের সময়কে বলেন, করোনা মহামারীর কারণে বিচার বন্ধ না থাকলে এতদিনে রায় হয়ে যেত। আজ বুধবার থেকে আদালত চালু হলেই নতুন তারিখ নির্ধারণের পর শুনানি হবে। খুব শিগগিরই এ মামলার বিচার শেষ হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিযোগ প্রমাণ করার যথেষ্ট ডকুমেন্টস আমাদের রয়েছে। এসকে সিনহা যে সম্পৃক্ত ছিলেন তা প্রমাণ করতে পারব। এ ছাড়া ঋণ নেওয়ার পর তিনি কিভাবে মানিলন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, সেটার প্রমাণও রয়েছে। এই আইনজীবী আরও বলেন, প্রথমত ঋণ অনুমোদন যাদের নামে করিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) থেকে টাকা সুপ্রিমকোর্টের সোনালী ব্যাংকের শাখায়
উনার অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। পরে তিনি টাকা তুলেছেন, সেটি তার ভাই ও ভাতিজার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছেন। ক্যাশ টাকাও উঠিয়েছেন। নিজের বেঞ্চ অফিসারকে দিয়ে টাকা উঠিয়েছেন। মীর আহম্মেদ আলী সালাম বলেন, যেসব ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে এর মধ্যে দ-বিধির ৪০৯ ধারায় দোষী প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদ- হতে পারে।
যে অভিযোগে মামলা : দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন ২০১৯ সালের ১০ জুলাই এসকে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। অভিযোগে বলা হয়, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় আলাদা দুটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। পরদিন তারা ওই ব্যাংক থেকে দুই কোটি টাকা করে চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। তাদের অ্যাকাউন্ট ও ঋণের আবেদনে উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টর ১২ নম্বর রোড ৫১ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, এর মালিক ছিলেন এসকে সিনহা। আবেদনে ঋণের জামানত হিসেবে আরেক আসামি রণজিৎ চন্দ্রের স্ত্রী শান্ত্রী রায়ের নামে সাভারের ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয়। এই দম্পতি এসকে সিনহার পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে এজাহারে।
দুদক বলছে, ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি একেএম শামীম কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ব্যাংকের নিয়মনীতি না মেনে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ দুটি অনুমোদন করেন। ৭ নভেম্বর ঋণের আবেদন হওয়ার পর ‘অস্বাভাবিক দ্রুততার’ সঙ্গে তা অনুমোদন করা হয়। পরদিন চার কোটি টাকার দুটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয় এসকে সিনহার নামে। ৯ নভেম্বর সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিমকোর্ট শাখায় এসকে সিনহার অ্যাকাউন্টে তা জমা হয়।
পরে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা তোলা হয়। এর মধ্যে এসকে সিনহার ভাইয়ের নামে শাহজালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার অ্যাকাউন্টে দুটি চেকে ২ কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয় ওই বছরের ২৮ নভেম্বর। এজাহারে বলা হয়, ‘আসামি রণজিৎ চন্দ্র ঋণ দ্রুত অনুমোদনের জন্য প্রধান বিচারপতির প্রভাব ব্যবহার করেন। ঋণগ্রহীতা নিরঞ্জন রণজিৎ চন্দ্রের ভাতিজা এবং অন্য ঋণগ্রহীতা শাহজাহান রণজিতের ছোটবেলার বন্ধু। ঋণগ্রহীতা দুজনই অত্যন্ত গরিব ও দুস্থ। তারা কখনো ব্যবসাবাণিজ্য করেননি। অন্যদিকে, শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্রের আইনজীবীরা দুদকে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এসকে সিনহার উত্তরার ৬ তলা বাড়িটি ২০১৬ সালের শুরু দিকে টাঙ্গাইলের বাসিন্দা শান্ত্রী রায় ৬ কোটি টাকায় কেনেন। বায়নাকালে ২ কোটি টাকা পরিশোধ করেন। বাকি চার কোটি টাকা পরিশোধের জন্য তিনি নিরঞ্জন ও শাহজাহানের সহযোগিতা নেন। মামলার সাক্ষ্যে এসকে সিনহার বড় ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহা ও মামাতো ভাইয়ের ছেলে শঙ্খজিৎ সিনহা জানান, এসকে সিনহার অনুরোধে তারা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের কিছু কাগজপত্রে সই করেন। তারা কখনই ওই ব্যাংকে যাননি। সব বিষয়ে এসকে সিনহাই জানতেন।
২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর মামলায় চার্জশিট দেন তদন্ত কর্মকর্তা। ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ৪-এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম আসামিদের বিচার শুরু করেন। আসামিদের মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী) কারাগারে, ব্যাংকের সাবেক এমডি একেএম শামীম, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ভাইস প্রেসিডেন্ট লুৎফুল হক, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা জামিনে আছেন। পুলিশের খাতায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা, ব্যাংকটির ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, রণজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী শান্ত্রী রায় পলাতক।
জানতে চাইলে আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি দুর্নীতি-অনিয়ম করে থাকলে তার বিচার করতে কোনো বাধা নেই। তিনি জানান, সংবিধানে একমাত্র রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে রক্ষাকবচ দেওয়া আছে। তবে পদ থেকে সরে যাওয়ার পর রাষ্ট্রপতিকেও যে কোনো ঘটনার জন্য বিচারের মুখোমুখি করতে কোনো বাধা থাকে না।
উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে সংসদের হাতে নিয়ে করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়ে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরে শুরুতে ছুটিতে ও পরে বিদেশ যান তখনকার প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। ১০ নভেম্বর বিদেশ থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। তিনি এখন আছেন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে কানাডায়। দেশের ২১তম ও প্রথম উপজাতি প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১৫ সালে শপথ নেন এসকে সিনহা।
Leave a Reply