সাধারণত প্রাচীন মিসরের বিভিন্ন দেব-দেবী, শাসক ও রাজপরিবারের ব্যক্তিবর্গের মূর্তি তৈরি করা হতো। তাদের জীবদ্দশায় এসব মূর্তির কোনো ক্ষতি করা হতো না। হাজার বছর পর উদ্ধার করা এসব মূর্তিগুলোকে নাক ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়। ব্রুকলিন যাদুঘরের মিসরীয় আর্ট গ্যালারির কিউরেটর এডওয়ার্ড ব্লাইবার্গের কাছে দর্শনার্থীরা সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি করেছে তা হলো, ‘মূর্তিগুলোর নাক ভাঙা কেন?’
হাজার বছর আগের প্রাচীন নিদর্শনগুলোতে কালের বিবর্তনে ক্ষতিসাধন হবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে মিসরীয়বিদ্যায় তার প্রশিক্ষণ থাকার কারণে মূর্তিগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করেন ব্লাইবার্গ। সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে ভাবতে ভাবতে নিদর্শনগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করার ইঙ্গিত পান তিনি।
ব্লাইবার্গ বলেন, ‘ভাস্কর্যগুলো ভাঙার যে ধারাবাহিকতা পাওয়া যায় তা থেকে বোঝা যায় সেগুলো উদ্দেশ্যমূলক।’
দুর্ঘটনাক্রমে ক্ষতি এবং ইচ্ছাকৃত ভাঙচুরের মধ্যে পার্থক্যের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি। ত্রি-মাত্রিক মূর্তির ওপর প্রসারিত নাকগুলো সহজেই ভেঙে যেতে পারে। তবে সমান চিত্রেও নাকগুলো ধ্বংস অবস্থায় পাওয়া যায়। এর কারণ ইচ্ছাকৃতই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘ভাঙচুরের ঘটনাগুলোর পেছনের অগণিত রাজনৈতিক, ধর্মীয়, ব্যক্তিগত এবং আক্রোশ কাজ করেছে।’
মূর্তির প্রাণ কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে নাক ভাঙা
প্রাচীন মিসরীয়রা পাথর, ধাতু কিংবা কাঠের তৈরি মূর্তিগুলোকে কখনোই কোনো জড় পদার্থ মনে করেনি। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও প্রাচীন মিসরীয়রা বিশ্বাস করতেন, মূর্তির মধ্যেও জীবনী শক্তি রয়েছে।
এবং সেটা যদি কখনো খারাপ রূপে ফিরে আসে তাহলে তাদের ক্ষতিসাধন করতে পারে। এই বিশ্বাসের কারণে প্রাচীন মিসরীয়রা সিদ্ধান্ত নেন যে এসব মূর্তিকে হত্যা করতে হবে। আর তারা হত্যা করার একটি উপায়ও খুঁজে বের করেন। সেটি হলো এই মূর্তিগুলোর নাক ভেঙে ফেলা।
প্রাচীন মিসরীয়দের ধারণা ছিল- মূর্তির মধ্যে যে জীবনী শক্তি রয়েছে, সেটি তারা পায় নাক দিয়ে নেওয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে। এ কারণে তারা মনে করতো এসব মূর্তির শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য এদের নাক ভাঙতে হবে। তবে সবসময় শুধুমাত্র নাক ভেঙে ফেলা হতো সেটা নয়। নাকের পাশাপাশি মুখের অন্যান্য অংশ, হাত-পা ও পেটের বিভিন্ন অংশও ভেঙে ফেলা হতো।
নাক ভাঙার পেছনে ধর্মীয় কারণ
মিসরের প্রাচীন মূর্তিগুলোর নাক ভাঙার পেছনে ধর্মীয় কারণও ছিল। মূলত মিসরের এসব প্রাচীন মূর্তিগুলো আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫ শতক থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের মধ্যে তৈরি। যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগে তথা খ্রিস্টধর্মের প্রচলন শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকে মিসরীয়রা বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করত। এসব দেব-দেবীর মধ্যে অনেক প্রাণীও ছিল। তারা এসব দেব-দেবীকে মূলত ভয় করতো। সে কারণে তাদের প্রতিকৃতি তৈরি করে মন্দিরে রেখে দিয়ে প্রার্থনা করতো। তৎকালীন শাসকদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে ব্যক্তিগত মূর্তিগুলো প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হতো।
খ্রিস্টাব্দ প্রথম শতক থেকে তৃতীয় শতকের মধ্যে মিসরে খ্রিস্টধর্ম বেশ ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তখন অনেক মানুষ পৌত্তলিকতা ছেড়ে খ্রিস্টধর্মের দিকে চলে আসে। এর ফলে একদিকে যেমন মূর্তি তৈরির কাজ কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে, তেমনি এদের সাথে যারা জড়িত তারা প্রায়ই হামলার শিকার হতে থাকে। এ কারণে অনেক ভাস্কর তাদের তৈরি মূর্তিগুলোকে সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। কিন্তু ভুলভাবে সংরক্ষণের কারণে অনেক মূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের দিকে মিসরে পুরোপুরি ইসলাম ধর্মের প্রচলন ঘটে। ইসলাম ধর্মানুযায়ী মূর্তি পূজা করা এবং এসবের সাথে জড়িত থাকা গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া যখন মিসরীয়রা ইসলামের পথে আসেন তখন তারা অনুধাবন করেছিলেন যে, এসব পাথর বা কাঠের মূর্তির কোনো শক্তি নেই। এর ফলে তখন প্রাচীন মূর্তিগুলোর প্রতি ভয় একেবারেই কেটে যেতে থাকে। মানুষ তখন মূর্তিগুলোকে বিভিন্ন আকারে কেটে বাড়িঘর তৈরির কাজে ব্যবহার শুরু করে। আর এ কারণে যেসব প্রাচীন মিসরীয় মূর্তি পাওয়া গেছে এর অধিকাংশই কয়েক খন্ডে বিভক্ত। পুরোপুরি ভালো অবস্থায় পাওয়া গেছে এমন মূর্তি একেবারেই কম।
তবে প্রাচীন মিসরীয় মূর্তিগুলোর নাক ভাঙা থাকার পেছনে জীবনী শক্তিকে বিনাশ করার জন্য নাক কেটে ফেলার ভ্রান্ত ধারণাটিই যুক্তিযুক্ত। কারণ ধর্মীয় কারণে মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলা হলে সেটা একেবারেই নিশ্চিহ্ন করা হতো।
ব্লাইবার্গের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে “স্ট্রাইকিং পাওয়ার : আইকোনোক্লাজম ইন অ্যানসিয়েন্ট ইজিপ্ট” নামের একটি আলাদা বিদ্রুপাত্মক প্রদর্শনী হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২৫ শতক থেকে খ্রিস্টাব্দ প্রথম শতাব্দী পর্যন্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত ভাস্কর্যগুলো যৌথভাবে নানা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়েছে।
Leave a Reply