ক্যালেন্ডারের ১২ পাতা ঘুরে শুরু হয়েছে নতুন পঞ্জিকা। আজ ২০ ফেব্রুয়ারি। ঠিক এক বছর আগের এই দিনেই রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে কয়লা হয়েছিল ৭১ জন। এই ঘটনায় স্বজন হারানো প্রত্যেক পরিবারের হৃদয়েই তৈরি হয়েছে অসহ্য বেদনার ক্ষত। ওই দিনের আগুনে পরিবারের আপনজনকে হারিয়ে নিভে গেছে অনেক সংসারের প্রদীপ শিখা। এক দিকে আপনজন হারানোর ব্যথা অন্য দিকে সংসারের টানাটানিতে নিহতদের অনেক পরিবারে এখনো চলছে শোকের মাতম। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেক পরিবার ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। দিন চলছে তাদের নিদারুণ কষ্টে। এ দিকে মর্মান্তিক এ ঘটনার পর এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে দাবি-দাওয়া আলোচনা ও সুপারিশমালার ফানুস উড়লেও এখন সব ঠাণ্ডা, পরিস্থিতি যেই কি সেই। অন্য দিকে ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য চোখের পানি, সান্ত্বনা বাক্য এবং সহায়তায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিশ্রুতির ধুম পড়লেও সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়নি। এখন কেউ খবরও নেয় না হতভাগ্য এসব লোক কেমন আছেন।
গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের সেই আগুনে আহত হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু কতজন যে দৌড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন, তার সঠিক সংখ্যা জানা নেই কারও। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো ধুঁকছেন শরীরে পোড়া ত নিয়ে, কেউ গ্রামে গিয়ে আর ফেরেননি, ফেরার ইচ্ছাও নেই তাদের। ওই রাতে চুড়িহাট্টা মোড়ে চারতলা ওয়াহেদ ম্যানশন নামে একটি ভবনে আগুন লাগার পর খুব দ্রুতই সেই আগুন আশপাশের কয়েকটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক ভবনের নিচের কয়েকটি দোকান মেরামত করে নতুনভাবে শুরু করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভবনটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় স্থানীয় ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার বাধায় তা আর হয়নি।
চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর অনেক ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেক পরিবার এখন প্রায় সর্বহারা। এ দিকে শুধু চুড়িহাট্টাবাসী নয় মিডিয়ার বদৌলতে পুরো পৃথিবীর মানুষ যে দৃশ্য সে দিন দেখেছিল তা কখনও ভুলবার নয়। বছর ঘুরে ভয়াবহ সেই রাতের এক বছর পার হয়েছে। কিন্তু এই এক বছরে বদলায়নি কিছুই। সরু গলিতে এখনো সেই যানজট। বাসঘরের নিচে দাহ্য বস্তু আর রাসায়নিকের গুদাম। পুড়ে যাওয়া পাঁচটি ভবনের মধ্যে চারটির সংস্কার করা হয়েছে। কিছুটা সংস্কার হয়েছে সেই ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচের অংশও। চুড়িহাট্টার বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও এখনো হতাহত মানুষের স্বজনদের বুকের ভেতর জ্বলছে সেই আগুন। স্বজন হারানো বাসিন্দারা এখনো ডুকরে কাঁদেন সেই স্মৃতি মনে করে।
ঢাকা ছেড়েছে নাহিদা : এ দিকে চুড়িহাট্টার আগুনে উপার্জনক্ষম স্বামীকে হারিয়ে ছাইচাপা পড়েছিল নাহিদার দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ। সমাজের নানাজনে সহায়তার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে সেভাবে এগিয়ে আসেননি কেউই। গত এক বছর অম্ল মধুর অভিজ্ঞতা নিয়ে দুই মাস আগে ঢাকা ছেড়েছেন আগুনে নিহত নোয়াখালী সোনাইমুড়ীর আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর স্ত্রী নাহিদা আক্তার। দুই সন্তানকে ভর্তি করেছেন গ্রামের স্কুলে। চুড়িহাট্টার আগুনে নিহত মঞ্জুর স্ত্রী ও তার দুই সন্তানকে নিয়ে গত বছর ৪ এপ্রিল একটি মানবিক রিপোর্ট প্রকাশ করে নয়া দিগন্ত। সমাজের অনেকে নাহিদার দুই সন্তানের পড়ালেখার জন্য আর্থিক সহায়তাও দেন। অনেকে দেন প্রতিশ্রুতি। কিন্তু অনুদানের অর্থ বছর না ঘুরতেই শেষ। ফলে বাধ্য হয়েই দুই সন্তানকে সাথে নিয়ে ঢাকা ছাড়তে হয়েছে নাহিদাকে।
দীর্ঘ এই এক বছর পরে নাহিদা তার দুই সন্তানকে নিয়ে কেমন আছেন তা জানতে যোগাযোগ করা হয় তার সাথে। টেলিফোনে নাহিদা এই প্রতিবেদককে জানান, বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে দুই সন্তানকে আর্থিক সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি ওই সময়ে পেয়েছিলাম তাদের মধ্যে অনেকেই পরে আর যোগাযোগ করেননি। ঢাকায় থাকতে প্রতি মাসেই বড় অঙ্কের টাকা বাড়ি ভাড়ায় চলে যায়। সন্তানদের স্কুলের খরচ আর খাওয়া-দাওয়ার ব্যয় নির্বাহ করা আমার পক্ষে কোনো মতেই আর সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ডিসেম্বর মাসে ছেলের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে গ্রামে চলে এসেছি। সোনাইমুড়ীর নাটেশ্বরে একটি স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করেছি। মেয়েকেও গ্রামেই ভর্তি করার চিন্তা করছি।
নাহিদা আরও বলেন, ছেলে রাফিনুর রহমান মাহিকে আমার বোনের দায়িত্বে দিয়েছি। বোনের বাড়ি নাটেশ্বরে। বোনই আমার ছেলের লেখাপড়ার খরচ নির্বাহ করছে। অন্য দিকে মেয়ে ফাহমিদা রহমান সাঞ্জুকে নিয়ে আমি থাকি এখন আমার ভাইয়ের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। অনেক কষ্টে কোনোমতে দিন যাচ্ছে আমাদের। অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি কোনো সহায়তা পাইনি। সিটি করপোরেশন থেকে বার বার সহায়তার আশ্বাস দেয়া হলেও আজো আমি কিছুই পাইনি। এখন আমি থাকি নোয়াখালীতে। তাই ঢাকায় গিয়ে কারো সাথে যোগাযোগ করাও এখন আর সম্ভব নয়। এ ছাড়া একা একা ঢাকায় যাওয়া বা থাকাও আমার পক্ষে সম্ভব না। সন্তানদের নিয়ে কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে গ্রামেই মাটি কামড়ে আছি।
নাহিদা বলেন, গ্রামে আমার স্বামীর ভিটায় ২১ শতাংশ জমি আছে। সেখানে সন্তানদের জন্য বাড়ি ঘর তৈরি করে থাকতে চাই। ছেলে আমার সংসারের হাল ধরার মতো অবস্থা হতে এখনো সাত-আট বছর অপেক্ষায় থাকতে হবে। অনিশ্চিত এই ভবিষ্যতের কথা মাথায় আসতেই দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে আমার। নাহিদা আরও বলেন, আমি এখন আমার একমাত্র ভাই মেজবাউর রহমানের বাড়িতেই থাকি। ভাইয়ের আয় রোজগারও বেশি না। বাজারের একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করেন আমার ভাই। উপায়ান্তর না থাকায় এই স্বল্প আয়ের মধ্যেই মাসহ ভাইয়ের পাঁচ সদস্যের সংসারে আমাকেও বোঝা হয়ে থাকতে হচ্ছে।
দেশব্যাপী বিশেষ দোয়া কাল : এ দিকে চুড়িহাট্টার আগুনে নিহতদের রূহের মাগফিরাত কামনায় আজ বৃহস্পতিবার চকবাজারের ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে দোয়ার আয়োজন করেছে নিহতদের পরিবার। একই সাথে দিনব্যাপী কুরআনখানিরও আয়োজন করেছে বিভিন্ন সংগঠন। সকাল থেকেই কালোব্যাজ ধারণ এবং দুপুরে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করবে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন।
অন্য দিকে আগামীকাল শুক্রবার বাদ জুমা চুড়িহাট্টাসহ সারা দেশের মসজিদে বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছেন চুড়িহাট্টা মসজিদ কমিটির সভাপতি হাজী আব্দুল হাসনাত টুনটুন। তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, শুধু চুড়িহাট্টাতেই নয়, চকবাজারসহ অন্যান্য স্থানেও নিহতদের স্মরণে কাল বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হবে। একই সাথে তিনি সারা দেশের মসজিদ কমিটিগুলোকে বাদ জুমা চুড়িহাট্টায় নিহতদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া করার জন্যও ইমাম ও খতিবদের প্রতি অনুরোধ জানান।
Leave a Reply