সীমান্তবর্তী ৮ জেলায় করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বাড়লেও সেই তুলনায় চিকিৎসা সক্ষমতা একেবারেই কম। এর মধ্যে অন্তত তিনটি জেলায় করোনা পরীক্ষার জন্য পিসিআর ল্যাব পর্যন্ত নেই। সংক্রমণ বাড়তে থাকা ৪টি জেলার হাসপাতালে নেই আইসিইউ। সেন্ট্রাল অক্সিজেন, হাইফ্লোন্যাজাল ক্যানুলা ও জনবল সংকটও প্রবল। নিতান্তই অপ্রতুল এই সেবা-সামর্থের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাসপাতালের অপর্যাপ্ত শয্যাসংখ্যাও। সব মিলিয়ে প্রশ্ন জেগেছে, করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকা সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এ প্রাণঘাতী মহামারীতে আক্রান্তদের চিকিৎসা মিলছে কতটুকু?
সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিশেষ লকডাউন আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে ইতোমধ্যেই। এছাড়া সীমান্তবর্তী আরও ৭ জেলায় লকডাউন ঘোষণার বিষয়েও ভাবছে সরকার। গতকাল সোমবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, সীমান্তবর্তী সাত জেলায় লকডাউনের মতো কঠোর বিধিনিষেধ জারি করতে দেরি হলে সংকট আরও বাড়বে। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এটি পর্যালোচনা করছে। আমচাষিদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে হয়তো দেরি হচ্ছে। আমরা চাই, দ্রুত লকডাউন দেওয়া হোক প্রস্তাবিত
জেলাগুলোয়।
সীমান্তবর্তী এসব জেলায় করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের হার ক্রমশ বাড়ছে। ঈদের আগেও এসব জেলায় শনাক্তের হার ছিল কমবেশি ১০ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে তা ২০ থেকে ৬০ শতাংশের ওপরে। স্থানীয় সিভিল সার্জন অফিসের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জÑ এ তিন জেলায় পিসিআর ল্যাব নেই। আইসিইউ নেই নওগাঁ, নাটোর, কুষ্টিয়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এসব জেলার কয়েকটিতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সুবিধাও নেই।
ঈদকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ বড় শহরগুলো থেকে লাখ লাখ মানুষ গ্রামেগঞ্জে যায়। সে সময় বাড়িমুখী মানুষ উপেক্ষা করেছে স্বাস্থ্যবিধি। তখনই শঙ্কা করা হয়েছিল, ঈদের পর সংক্রমণ বাড়তে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত এক সপ্তাহে সংক্রমণ বাড়ছে। অর্থাৎ ঈদের পর দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আগেরদিন সকাল থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও ১৭১০ জন কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাতে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮ লাখ ৫৪০ জন। অর্থাৎ শনাক্ত রোগীর সংখ্যঅ ৮ লাখ পার হলো গতকাল। আক্রান্তদের মধ্যে আরও ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এই ২৪ ঘণ্টায়।
এ দিকে সংক্রমণের বৃদ্ধির গত শনিবার জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে আলোচনার ভিত্তিতে ৭ জেলায় লকডাউন দেওয়াসহ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন গতকাল রাতে আমাদের সময়কে বলেন, সংক্রমণ বাড়লেও জটিল রোগীর সংখ্যা কম। পর্যাপ্ত শয্যা আছে। প্রয়োজনে সাধারণ শয্যা আরও বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া আছে। এ মুহূর্তে আইসিইউ শয্যা চাইলেও বাড়ানো সম্ভব নয়। যাদের আইসিইউ প্রয়োজন হচ্ছে তাদের পাশের জেলার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হচ্ছে। হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানলা প্রয়োজনও মেটানো হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্র বলছে, রাজশাহীতে করোনা শনাক্তের হার কিছুটা কম থাকলেও আশপাশের কয়েকটি জেলার রোগী আসায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চাপ বাড়ছে। করোনা রোগীর চিকিৎসায় শয্যা, আইসিইউ কিংবা ভেন্টিলেশনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি না থাকায় রাজশাহীতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। মাত্র দুটি আরটি-পিসিআর ল্যাবে (রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ এবং রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল) করোনার নমুনা পরীক্ষা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ দুটি পিসিআর ল্যাবে একসঙ্গে ১৮৮টি করে মোট ৩৭৬টি নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে। তবে পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত কিট থাকলেও পিসিআর ল্যাবের সক্ষতার অভাবে যে হারে রাজশাহী ও এর আশপাশের জেলাগুলোতে সন্দেহভাজন রোগী দেখা যাচ্ছে, সেই তুলনায় নমুনা পরীক্ষা সম্ভব হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রামেক হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য ২১৭টি সাধারণ শয্যা ও ১৫টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। সোমবার রামেক হাসপাতালের জেনারেল বেডে রোগী ছিল ২১৩ জন (আগের দিন রবিবার ছিল ২০৪ জন) ও আইসিউতে ১৫ জন। উপজেলা হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য ১০০ শয্যা থাকলেও সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন ও আইসিইউ নেই। তাই সেসব হাসপাতাল থেকেও রোগীরা রামেক হাসপাতালে আসে।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শামীম ইয়াজদানী জানান, প্রতিদিন যেভাবে রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে, তাতে দুই-একদিনের মধ্যেই শয্যার তুলনায় রোগী বেশি হয়ে যাবে। বর্তমানে আইসিইউর একটি শয্যার জন্য ২৬ জন রোগী অপেক্ষায় রয়েছে। এখানে আরও দুটি আইসিইউ শয্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে যে হারে রোগী বাড়ছে, তাতে ৫০টি আইসিইউ বেড বাড়ালেও রোগী পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হবে।
নাটোর জেলার ২০ লাখ মানুষের বিপরীতে করোনার ইউনিটের শয্যা রয়েছে মাত্র ৭১টি। আর সেন্ট্রাল অক্সিজেনের আওতায় রয়েছে মাত্র ৩৯টি বেড। নেই পিসিআর ল্যাব ও সেন্ট্রাল অক্সিজেন। নাটোরের সিভিল সার্জন ডা. মিজানুর রহমান বলেন, গত বছরও জেলায় সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা ছিল না। করোনা রোগীদের জন্য চলতি বছর এপ্রিলে সিংড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৮টি সেন্ট্রাল অক্সিজেন বেড এবং মে মাসে নাটোর জেলা সদর হাসপাতালে ৩১টি সেন্ট্রাল অক্সিজেন বেড স্থাপন করা হয়েছে। এ অবস্থায় নাটোরে সদরে ৩১ জন ও সিংড়ায় ৮ জনের বেশি কাউকে উচ্চগতি সম্পন্ন অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।
যে সব জেলায় করোনার সংক্রমণ বেশি বাড়ছে তার মধ্যে নওগাঁ অন্যতম। ঈদের আগে এই জেলায় সংক্রমণ হার ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ। বর্তমানে তা ২৪ শতাংশের বেশি। নওগাঁ জেলায় করোনা রোগীর চিকিৎসা প্রদানে জেলা সদর হাসপাতালে ৩০টি শয্যা ও উপজেলা হাসপাতালে ১৮০টি শয্যাসহ মোট ২১০টি শয্যা রয়েছে। কিন্তু এ জেলায় রোগী বাড়লেও সেখানে চিকিৎসা প্রদানে নেই আইসিইউ শয্যা, সেন্ট্রাল লাইনের অক্সিজেন সবরাহের ব্যবস্থা, ও রোগী শনাক্তে আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরি। সংকট রয়েছে জনবলেরও। গত রবিবার রাতে ঢাকা থেকে দুটি আইসিইউ শয্যা পাঠানো হয়েছে। কাজ চলছে সেন্ট্রাল লাইন অক্সিজেন ও আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরি স্থাপনের। এসব কাজ শেষ হলেও সেখানে জনবল সংকট কাটতে সময় লাগতে পারে।
সীমান্তবর্তী আরেক জেলা সাতক্ষীরায় ঈদের আগে সংক্রমণ হার ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে। এই জেলায় করোনার রোগীর চিকিৎসা প্রদানে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১২০টি, জেলা সদর হাসপাতালে ৩০টিসহ মোট ১৫০টি শয্যা রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে ৬০টি শয্যা রয়েছে। জেলা সদর হাসপাতালে আরও ১২০টি শয্যা বাড়ানোর কাজ চলছে। সাতক্ষারী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সেন্ট্রাল লাইন অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলেও জেলা সদর হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। এই জেলায় করোনার রোগীর চিকিৎসায় ৮টি আইসিইউ শয্যা ও ৩৮টি হাইফ্লো-ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে। সাতক্ষীরা জেলায়ও রয়েছে করোনা রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব।
খুলনায় গতকাল রবিবার চালু হওয়া ১০০ শয্যা ডেডিকেটেড হাসপতালের ২০টি আইসিইউ, ১০টি এইচডিইউ, ৪০টি রেডজোন ও ৩০টি ইয়োলো জোন বেডসহ সর্বমোট ১০০ বেড এখন রোগীতে পরিপূর্ণ। এ অবস্থায় দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের। খুলনা করোনা হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. সুহাস হালদার বলেন, উদ্বেগজনকভাবে রোগী বাড়ছে। এ অবস্থায় হাসপাতালের সাবেক অর্থোপেডিক ও গ্যাস্ট্রোলজি বিভাগে করোনা হাসপাতালের দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের বিষয়টি আলোচনায় আছে। এছাড়া মুমূর্ষু রোগীদের জন্য আইসিইউ ও এইচডিইউসহ বেড বাড়ানো হলেও প্রথম দিনেই রোগী পরিপূর্ণ হওয়ায় কর্তৃপক্ষ অনেকটা হিমশিম খাচ্ছে।
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশুতোষ কর্মকার জানিয়েছেন, স্পেক্ট্রা কোম্পানির লিক্যুইড অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপনের জন্য স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ৯৭ লাখ টাকার চাহিদাপত্র দিয়েছিল। মন্ত্রণালয় থেকে সেটির অনুমোদন মিলেছে। ২/১ দিনের মধ্যেই প্লান্টটি বসানোর কার্যক্রম শুরু হবে।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংক্রমণ যখন বেশি তখন চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকটে ভুগছে ২৫০ শয্যার আধুনিক সদর হাসপাতালের করোনা ডেটিকেটেড ওয়ার্ড। জেলার আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. জাহাঙ্গীর আলম জানান, ঈদের আগে ও পরে থেকে জেলায় করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সদর হাসপতালের ৮ তলায় স্থাপিত ২০ শয্যা বিশিষ্ট করোনা ওয়ার্ডে ১৬ জন চিকিৎসকের স্থলে ১২ জন রয়েছে। অক্সিজেন অপ্রতুল। ৩টি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও ২টি চালু রয়েছে। সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী জানান, অক্সিজেনের ৩০টি সিলিন্ডার সবসময় হাসপাতালে থাকে এবং ৩০টি সিলিন্ডারে অক্সিজেন আনার জন্য পাঠানো হয় মানিকগঞ্জে। আশার কথা হলো, আগামী বুধবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে স্থাপিত অক্সিজেন প্ল্যান্ট চালু হলে পাইপলাইনের ম্যাধ্যমে লিকুইড অক্সিজেন নিরবচ্ছিন্ন দেওয়া সম্ভব হবে।
জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. মঞ্জুরুল হাফিজ জানান, হাসপাতালের কিছু সরঞ্জামের অভাব রয়েছে, বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে বলা হয়েছে। দ্রুত সময়ে সমাধানের আশ^াস দিয়েছে তারা।
কুষ্টিয়ায় ঈদুল ফিতরের পর ১৮ থেকে ২৯ মে পর্যন্ত ১২ দিনে ১ হাজার ৩৫৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২০২ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ভারত থেকে আসা বাংলাদেশি রয়েছেন ৩ জন। তারা সম্প্রতি ভারত থেকে ফেরার পর কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। বর্তমানে কুষ্টিয়ায় ভারত থেকে ফেরা ১৪২ জন বাংলাদেশি তিনটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও তিনটি আবাসিক হোটেলে কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। জেলায় যেসব করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে তাদের মধ্যে সংকটাপন্নদের কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে সার্বক্ষণিক অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেনের ব্যবস্থা আছে। তবে আইসিইউ নেই। বেশি মাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের ১২টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা থাকলেও এর তিনটি নষ্ট।
Leave a Reply