প্রাণঘাতী করোনার আঘাতে ধস নামা হোটেল ব্যবসায় সেই ধকল সামলাতে আরও ৫ থেকে ১০ বছর লাগতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। আবার করোনাও সহসাই আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না, ভাইরাসটি আরও পাঁচ বছর দাপট দেখাতে পারে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। এ ক্ষেত্রে বিপদকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে, বাঁচা শিখতে হবে বলে মনে করেন তারকা হোটেল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিহা) উপদেষ্টা ও ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহা. নূর আলী।
আমাদের সময়ের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘কীভাবে কৌশল করে বাঁচা যায়, কীভাবে চলা যায়- সেই পন্থাগুলোই গবেষণার মাধ্যমে বের করতে হবে।’ নূর আলী বলেন, ‘করোনাকালীন উন্নত দেশে হুট করেই হোটেল ও রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। তারা একটা দূরত্ব বজায় রেখে যেখানে ১০০ সিটের ক্যাপাসিটি আছে, সেখানে ২৫ অথবা ৩০ জন অতিথি গ্রহণ ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ডাইনিং খোলা আছে, রুমে বসে খেলে সমস্যা নেই, খাবার আনতে গেলে মাস্ক পরে যেতে হবে। এগুলোসহ বিভিন্ন নিয়ম-কানুন করে দিয়েছে তারা। আসলে তারা মাথাব্যথা হলে ওষুধ দিয়ে সেরে ফেলে। আর আমরা মাথাব্যথা হলে মাথাটাই কেটে ফেলছি।’
তিনি বলেন, ‘সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে প্রণোদনা থেকে শুরু করে ইনকাম ট্যাক্স ও ব্যাংকঋণের সুদ মওকুফ করেছে। ব্যাংকঋণের কিস্তি দেওয়ার সময়সীমা ১৫ থেকে ১৮ পর্যন্ত দীর্ঘ করে দিয়েছে। অন্যান্য দেশেও গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, ইনকাম ট্যাক্স ও ব্যাংকঋণের সুদ মওকুফ করে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে সিঙ্গাপুরে হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে ১১ হাজার রুম এক বছরের জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে নিয়ে নিয়েছে দেশটির সরকার। এ ছাড়া প্রতি নাগরিককে সরকার প্রতিদিন ১০০ ডলার করে দিচ্ছে থাকার জন্য। কোয়ারেন্টিনকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। আগে দুই সপ্তাহ ছিল এখন তিন সপ্তাহ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সেখানে।’
ওয়েস্টিন হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘এই ক্রান্তিকালে হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রিকে রক্ষায় আমাদের সরকারের পক্ষ থেকেও গবেষণার জন্য একটি কমিটি করে দিতে হবে। আর এই কমিটি সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ করে একটি সিস্টেম তৈরি করবে, যা আমরা পালন করব। এতে রোগ থেকেও আমরা দূরে থাকতে পারব, ব্যবসাটাও সীমিত আকারে চলল। যাতে আমাদের কর্মচারীদের অন্তত ছাঁটাই করতে না হয় এবং জরুরি খরচগুলোও মেটানো যায়।’
তিনি বলেন, ‘করোনাকালে অবশ্যই ব্যাংকঋণের সুদ ও ইনকাম ট্যাক্স মওকুফ করতে হবে, কিস্তি দেওয়ার সিডিউল দীর্ঘ করে দিতে হবে। তা না হলে হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রি দীর্ঘমেয়াদে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া হোটেলগুলো মেইনটেন্যান্স করতেও বিপুল অঙ্কের টাকা প্রয়োজন। ঠিকমতো তা করা না হলে করোনা চলে গেলেও অতিথিরা হোটেলে আসবে না। এসব সমস্যা সমাধান করতে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। যেহেতু এখন ব্যবসা নেই, তাই যে পর্যন্ত স্বাভাবিক না হবে, সে পর্যন্ত সরকারকেই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। কেননা সুদিনে আমরা প্রতিবছর সরকারকে কোটি কোটি টাকা ট্যাক্স-ভ্যাট দিয়ে আসছি। এখন আমাদের এই দুর্দিনে সরকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসবে- এটিই তো স্বাভাবিক। সব দেশে তাই করে, দুর্দিনে পাশে থাকে সরকার।’
আক্ষেপ নিয়ে মোহা. নূর আলী বলেন, ‘হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রিতে সর্বোচ্চসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান। অথচ করোনাকালে এ সেক্টরটি অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে। তার দিকে খেয়াল করার এবং প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলারও মনে হয় কোনো লোক নেই।’ তিনি বলেন, ‘এ সেক্টরে উন্নতমানের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে বলেই তো বিদেশি ইনভেস্টররা দেশে এসে থাকতে পারেন এবং ইনভেস্ট করতে পারেন। ভালোমানের হোটেল, পরিবেশ ও মেইনটেন্যান্স না থাকলে তো বিদেশিদের এ দেশে আসাই বন্ধ হয়ে যাবে। আগামীতে যে সুদিন আসবে তার জন্য দুর্দিনে শুধু মালিকের একার দায়িত্ব না হোটেলগুলোর পরিবেশ ঠিক রাখা। যেহেতু সরকার আমাদের পার্টনার, তাই প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে এসব ঠিক রাখা সরকারেরও দায়িত্ব রয়েছে। সুদিনে তো আমাদের ইনকামের অধিকাংশই সরকারকে দিয়ে দিই। আর পার্টনার হিসেবে দুর্দিনে পার্টনারের কী দায়িত্ব?’
এই হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, ‘এখন আমাদের ইনকাম নেই, তার পরও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিয়ে রাখতে হচ্ছে। ফলে এই করোনাকালে আমরা প্রণোদনা পাব না, তো কে পাবে?’
Leave a Reply