একদিনের অপেক্ষা মাত্র। তার পরই বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। পুরনো বছরের জরাজীর্ণতাকে মুছে ফেলে ঐক্য ও অসাম্প্রদায়িকতার বাণী নিয়ে একই বন্ধনে মিলিত হবে জাতি। সব ভেদাভেদ ভুলে দলমত-জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই উৎসব আনন্দে বরণ করে নেবে বাংলা নববর্ষ ১৪২৮-কে। আর আমাদের বর্ষবরণের আয়োজনের অন্যতম অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। করোনা মহামারীর কারণে এবার অবশ্য সেই যাত্রা বাইরে বের হবে না, চারুকলা অনুষদের ভেতরেই উদ্যাপন হবে সীমিত পরিসরে। সর্বজনীন এই উৎসবের রঙ ছড়িয়ে দিতে তাই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। প্রতিবছর সমকালকে পর্যবেক্ষণে নিয়ে তার আলোকে জাতির উদ্দেশে একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেন মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজকরা। সে অনুযায়ী এবারের প্রতিপাদ্য নির্বাচন ও পোস্টার ডিজাইন করা হয়েছে। প্রতিপাদ্য হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত রচনা থেকে ‘কালো ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর’ অংশটুকু গ্রহণ করা হয়েছে। পোস্টার ডিজাইন করেছেন আনিসুজ্জামান সোহেল। দমবন্ধ এই সময়ে চমৎকার এই পোস্টার দেখে যে কারও মন ভালো হয়ে যাবে। গভীর অন্ধকার ভেদ করে উড়ে আসছে রঙিন দুটি পাখি। এক ঝলক আলো নিয়ে উৎসব আনন্দ আর ভরপুর প্রাণের মাধ্যমে বার্তা দিচ্ছে- জয় হবে শুভ সুন্দরের। জীবনের জয় হবে।
করোনা মহামরীতে ভার্চুয়ালি নয়, বরং প্রতীকী আয়োজন নিয়ে বাঙালির উদ্যাপনের সঙ্গে থাকবেন চারুশিল্পীরা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক শটি ডিজাইন থাকছে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায়। চারুকলা অনুষদের ওই আয়োজনে অংশ নেওয়ার সুযোগও পাচ্ছেন ১০০ জন। সেভাবেই চলছে প্রস্তুতি। এর আগে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পহেলা বৈশাখে লোকসমাগম এড়িয়ে সম্ভব হলে ভার্চুয়ালি উৎসব অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুরোধ করা হয়। তবে সবকিছু মোটামুটি চলমান থাকায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতীকী উৎসব আয়োজনের পক্ষে অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন আয়োজকরা। তাদের মতে, করোনার আঘাত ঘোরতর হয়ে উঠছে। পাশাপাশি বাঙালির সব অর্জন গিলে খেতে চাইছে ধর্মীয় মৌলবাদীরা। আশা করছেন, অচিরেই দূর হবে করোনা। মৌলবাদী অপশক্তিও টিকতে পারবে না বেশিদিন। শুভ সুন্দরের এমন প্রত্যাশার কথা জানাতেই আয়োজন করা হবে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা।
চারুকলা অনুষদ থেকে জানা যায়, যথারীতি পহেলা বৈশাখ সকাল ৯টায় মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হবে। এবার শোভাযাত্রার আকার আগের মতো অত বড় না হলেও উৎসবের চেহারা অবিকলই থাকবে। সীমিত পরিসরেই হবে আকর্ষণীয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। করোনা সংক্রমণ বাড়ায় স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হবে। পরস্পরের মধ্যে অন্তত দশ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা হবে। আর তাতে অংশ নেওয়ার সুযোগ মিলবে কেবল ১০০ সৌভাগ্যবানের। বড় কোনো স্ট্রাকচারাল ফর্ম রাখা হবে না এবার। চাকাজুড়ে দেওয়া বিশাল ঘোড়া পাখি ইত্যাদি নিয়ে শহর প্রদক্ষিণেরও সুযোগ নেই। তবে একটি বড় চর্কার মতো শিল্পকর্ম রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর বাইরে অংশগ্রহণকারীরা প্রত্যেকে নিজেদের হাতে একটি করে শিল্পকর্ম বহন করবেন। সে হিসেবে ১০০টি উপস্থাপনা থাকবে শোভাযাত্রায়। বৈশাখী আয়োজনের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ মুখোশ। এবার ফেস শিল্ডকেই মুখোশের মতো করে গড়ে নেওয়া হবে। ব্যতিক্রমী এই মুখোশ পরবেন অংশগ্রহণকারীরা। সব মিলিয়ে সীমিত পরিসর হলেও, আকর্ষণীয় করেই উপস্থাপন হবে বিষয়টিকে। এরই মধ্যে চারুকলার দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে হরেক রঙের চিত্রকর্ম।
মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব নিজার খান খোকন বলেন, ‘করোনাকে মাথায় রেখে মূলত এবারের ফেস শিল্ড থিম আমাদের। এ ছাড়া রাজা-রানী, বর্ম এ বিষয়গুলোকে এবার আমরা তুলে ধরছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ বছরপূর্তি উপলক্ষে এক শটি শিল্পকর্ম তৈরি করছি। যার মধ্যে রয়েছে মুখোশ, সরা ও নানারকম ফেস্টুন। যারা শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন তারা মুখোশগুলো ধরে রাখবেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে থাকি। এটার উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ ও জাতির মঙ্গল। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে গত বছর আমরা এটি উদযাপন করতে পারিনি। এ বছর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। তবে শেষ মুহূর্তে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় সর্বোচ্চ স্বাস্থবিধি মেনে সীমিত পরিসরে শোভাযাত্রা বের করা হবে।’
এই আয়োজনে কেবল চারুকলা অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই অংশ নেবেন বলে জানান চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়েছি। স্বল্প পরিসরে আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে। স্বাস্থ?্যবিধি মেনেই এটি করা হবে।’ এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমরা দুটি বড় দুর্যোগের মুখোমুখি। একটি নিঃসন্দেহে করোনা; আরেকটি মৌলবাদের উত্থান। সংক্রমণব্যাধি সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। বর্তমানে করোনা সংক্রমণ আরও ঊর্ধ্বমুখী। করোনাকালে প্রকৃতি নিয়ে নতুন করে ভাবছি আমরা। মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক, সে সম্পর্ক নিয়ে নতুন রিয়ালাইজেশন হচ্ছে। এভাবেই উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে এ কথাটিই বলার চেষ্টা করা হবে। একই সময়ে আমরা দেখেছি মৌলবাদের উত্থান। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সব সময় স্বোচ্চার ছিলেন শিল্পীরা। মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে এই অপশক্তিকে যে কোনো মূল্যে দমন করার কথা বলব আমরা।’
১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিবছর বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নানা দিক তুলে ধরে মানুষের অনাবিল সুখ-সমৃদ্ধি ও মঙ্গলালোক কামনা করে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে মানবতার অধরা বা অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে গত বছর পহেলা বৈশাখে কোনো আয়োজনই হয়নি। বর্ষবরণের বাজেটের সেই টাকা আর্তমানবতার সেবায় খরচ করা হয়।
Leave a Reply