২০১৯ সালের শেষ দিকে নভেল করোনা ভাইরাস নামে যে মরণ জীবণুটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল গোটা বিশ্বের মানুষ, প্রায় ১৪ মাস পেরিয়ে সে লড়াই অব্যাহত আছে এখনো। এর মধ্যে বারবার ধরন পাল্টে আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও সংক্রামক হয়েছে করোনা। ফলে আগের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ নিয়ে গোটা বিশ্বেই শুরু হয়েছে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ।
এর মধ্যেই বিজ্ঞানীদের নিবিড় গবেষণার ফসল হিসেবে চিকিৎসকদের হাতে এসেছে বেশ কয়েকটি টিকা। বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে ব্যাপক টিকাদান কার্যক্রমও। কিন্তু তবু আক্রান্তের ঊর্ধ্বগতি ও মৃত্যু থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। বরং প্রায় প্রতিদিনই আক্রান্ত-মৃত্যুর সংখ্যা ভেঙে দিচ্ছে পেছনের রেকর্ড।
স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন, চলাফেরায় বিধিনিষেধ, লকডাউন, অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততা, বেকারত্বসহ সব মিলিয়ে গোটা বিশ্ব এখন কার্যত করোনাক্লান্ত। করোনার প্রথম ঢেউয়ে তথৈবচ প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখন সত্যিই ধুঁকছে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা সামাল দিতে। তার ওপর চিকিৎসকদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে অধিক সংক্রামক ও ভয়ঙ্কর ব্রিটিশ স্ট্রেন, ব্রাজিল স্ট্রেন, আফ্রিকান স্ট্রেন, ভারতীয় ডবল মিউটেন্ট স্ট্রেনসহ করোনার নতুন নতুন বিবর্তিত ধরন।
আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত গোটা বিশ্বে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি ৪৬ লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার একদিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ৭ লাখ ৪৭ হাজারের বেশি মানুষ। একই দিন গোটা বিশ্বে মারা গেছেন প্রায় ১৪ হাজার মানুষ। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশ্বে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ লাখ ১৮ হাজারের বেশি। গুরুতর অসুস্থাবস্থায় রয়েছেন লক্ষাধিক। তবে আশার কথা হলো, এর মধ্যেই সুস্থ হয়েছেন ১০৮ কোটি ৪২ লাখের বেশি মানুষ। জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির বৈশ্বিক করোনা সংক্রমণ ম্যাপে দেখা যায় একমাত্র অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ ছাড়া
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ও অঞ্চলগুলো রয়েছে বিপজ্জনক লাল রঙের আওতায়। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়া মাইনর, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় গোটা অংশই সংক্রমিত। আফ্রিকায়ও সংক্রমণের মাত্রা দিনকে দিন বাড়ছে। তবে একটু হলেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রিত আছে অস্ট্রেলিয়ায়।
আক্রান্ত ও মৃত্যুতে আগের মতোই বিশ্বে শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত ৩১ কোটি ৭১ লাখের বেশি মানুষ। মারা গেছেন ৫ লাখ ৭৩ হাজারের বেশি। গত বৃহস্পতিবারও ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে সহস্রাধিক মানুষের প্রাণ গেছে। গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে ভাইরাস সংক্রমণের প্রায় অর্ধেকই ঘটছে দেশটির মাত্র পাঁচটি রাজ্যে। এগুলো হলো নিউইয়র্ক, মিশিগান, ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া ও নিউ জার্সি। এর মধ্যেই আতঙ্ক নিয়ে সেখানে হাজির হয়েছে করোনার ভারতীয় ডবল মিউটেন্ট স্ট্রেন ধরন। গত ৫ এপ্রিল সানফ্রানসিসকোয় এক ব্যক্তির শরীরে এই ধরনের করোনা ভাইরাসের সন্ধান মেলে। ভারতে হঠাৎ করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে এই ডবল মিউটেন্টকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। যুক্তরাষ্ট্রেও এই ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়লে পরিণতি মারাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের।
আক্রান্ত ও মৃত্যুতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। করোনা নিয়ে সরকারি উদাসীনতার বড় উদাহরণ ব্রাজিলে এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ৩২ লাখ ৮৬ হাজার ছাড়িয়েছে। মারা গেছেন ৩ লাখ ৪৫ হাজারের বেশি মানুষ। প্রতিদিনই দেশটিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুতে বিশ্বরেকর্ডের খবর আসছে। গত বৃহস্পতিবার একদিনেই দেশটিতে মারা গেছেন চার হাজারের বেশি মানুষ।
আক্রান্ত ও মৃত্যুর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে ভারত। দেশটিতে প্রতিদিনই সংক্রমণ বাড়ছে লাফিয়ে। ভারতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজারের বেশি, মারা গেছেন মোট ১ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি মানুষ। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, দেশটিতে গত বৃহস্পতিবার একদিনেই লক্ষাধিক আক্রান্ত রোগী শনাক্ত ও মারা গেছেন ৮০০-এর বেশি মানুষ। এর মধ্যে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী রাজ্য পশ্চিমবাংলায় চলছে বিধানসভা নির্বাচন। দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, ভোটের জন্য পশ্চিমবঙ্গজুড়ে চলছে প্রচারণা। এতে লোকজনের মধ্যে যেমন দেখা যাচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা, তেমনি চলছে জনসভাও। ফলে অচিরেই পশ্চিমবঙ্গে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে কোভিড পরিস্থিতি।
করোনা পরিস্থিতিতে ইউরোপেও চলছে সঙ্গিন অবস্থা। ধারণা করা হচ্ছে, এই মহাদেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে। ইউরোপের দেশগুলোয় এখন পর্যন্ত মোট শনাক্ত হয়েছে ৪ কোটি ১২ লাখের বেশি রোগী, মারা গেছেন ৯ লাখ ৪৩ হাজারের বেশি মানুষ। গত বৃহস্পতিবারও সেখানে প্রাণ গেছে চার সহস্রাধিক। এই মহাদেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুতে এখনো শীর্ষে আছে যথাক্রমে ফ্রান্স, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য। তবে ব্যাপক টিকাদান ও জনগণের চলাচলে গত কয়েক সপ্তাহ কড়া বিধিনিষেধের কারণে যুক্তরাজ্যে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা কমে এসেছে।
ব্রিটিশ জনস্বাস্থ্য বিভাগের এক গবেষণা বলছে, যুক্তরাজ্যে গণহারে দ্রুত টিকা প্রদানের কারণে অন্তত ১০ হাজার ৪০০ মৃত্যু প্রতিরোধ করা গেছে। দ্রুত টিকা নেওয়ায় মার্চে ঠেকানো গেছে ৬০ বছর বয়সী এবং এর ওপরের বয়সের ১০ হাজারেরও বেশি মৃত্যু। তবে ইউরোপে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে আছে পোল্যান্ড। বৃহস্পতিবারও সেখানে ৯৫৪ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ইউক্রেন, চেচনিয়া, নেদারল্যান্ডসসহ অন্য দেশগুলোয় আক্রান্ত ও মৃত্যু অব্যাহত আছে।
এদিকে করোনা পরীক্ষা নিয়ে নতুন উদ্বেগের খবর জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআই। ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গবেষণার বরাত দিয়ে সেখানে বলা হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ এলেও অনেকের শরীরে এ ভাইরাসটির উপস্থিতি থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ তারা ফলস নেগেটিভ হচ্ছেন। ইতোমধ্যেই ভারতের গুজরাট ও পশ্চিমবঙ্গে এমন অসংখ্য রোগীর খোঁজ পাওয়া গেছে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও তা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে সিটিস্ক্যান করাতে হবে।
চিকিৎসকরা বলছেন, আরটিপিসিআর টেস্টে রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরও অনেকের কাশি কমছে না, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তাদের সিটিস্ক্যান করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, ফুসফুসে গভীর সংক্রমণ। সে কারণেই তারা অনেক সময় একই সঙ্গে আরটিপিসিআর আর সিটিস্ক্যান করার পরামর্শ দিচ্ছেন। ভারতের ন্যাশনাল অ্যালার্জি অ্যাজমা ব্রঙ্কাইটিস ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও ফুসফুস রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অলোক গোপাল ঘোষাল বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই এখন আরটিপিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে করোনা ভাইরাস শনাক্ত করা যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে সিটিস্ক্যানে তা শনাক্ত হচ্ছে। সিটিস্ক্যান অনেক সূক্ষ্ম বিচার করতে সক্ষম। যদিও অনেকের সিটিস্ক্যান করার সামর্থ্য নেই। সে ক্ষেত্রে দুবার আরটিপিসিআর টেস্ট করতে হবে। রোগীর যদি জ্বর আসে, তা হলে সেদিন থেকে পাঁচ দিন পর দ্বিতীয়বার টেস্ট করার পরামর্শ দেন তিনি।
Leave a Reply