ফেনীর সোনাগাজীর আলোচিত মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির গায়ে আগুন ধরিয়ে হত্যার দুই বছর আজ। ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষার আরবী প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে গেলে হল থেকে ডেকে মাদ্রাসার পাশের আরেকটি ভবনের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা তুলে নিতে রাজি না হওয়ায় তার সহপাঠীরা তাকে গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে হত্যার চেষ্টা চালায়। নুসরাত হত্যার ২ বছরে তার বাড়িতে চলছে সুনশান নীরবতা। ঘটনরার পর থেকে আজ অবদি তার পরিবারের নিরাপত্তার জন্য ৩ পুলিশ সদস্য পাহারা দিচ্ছেন।
নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বলেন, আজ দুই বছর আমি আমার মেয়ের কণ্ঠে মা ডাকটি শুনতে পাই না। রাতে ঘুম হয় না। কারণ আমার মেয়ের হাত-পা বেঁধে যখন তারা আগুন লাগিয়েছিল, তখন আমার মেয়ে কি করেছিল? সেদিন আমি খবর পেয়ে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে ছুটে যাই, তখন পুলিশ সদস্যরা আমার মেয়ের কাছে ভিড়তে দেয় নাই। তার পুরো শরীর ব্যান্ডেজ করে ফেলে ডাক্তাররা।
তিনি বলেন, আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায় বিচার পেয়েছি।
শুনেছি উচ্চ আদালতে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামিরা আপিল করেছেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসামিদের রায় দ্রুত কার্যকরের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।
সোনাগাজী মডেল থানর অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সাজেদুল ইসলাম জানান, নুসরাতের উপর হামলার ঘটনার পর থেকে তার বাড়ির সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য ৩ পুলিশ সদস্য পাহারায় নিয়োজিত রয়েছে। পুলিশ সুপারের নির্দেশের যতদিন ওই পরিবারের নিরাপত্তা প্রয়োজন পুলিশ ততদিন নিরাপত্তা দিয়ে যাবে।
২০১৯ সালের ২৭ মার্চ নিজ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার যৌন নিপীড়নের শিকার হন রাফি। ওই ঘটনায় তার মা বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজকে একমাত্র আসামি করে মামলা করেন। একই দিন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ওই মামলা তুলে নিতে অধ্যক্ষের অনুসারী ওই মাদরাসার ছাত্ররা রাফি ও তার পরিবারের সদস্যদের চাপ দিতে থাকে।
২০১৯ সালের ৩রা এপ্রিল খুনিরা সিরাজের সঙ্গে কারাগারে পরামর্শ করে এসে ৪ঠা এপ্রিল মাদরাসার ছাত্রাবাসে নুসরাতকে হত্যা করার পরিকল্পনা নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ এপ্রিল নুসরাত মাদরাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে খুনিরা পরিকল্পিতভাবে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে শরীরে কেরোসিন তেল ঢেলে হত্যার চেষ্টা চালায়।
ঘটনাস্থল থেকে নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে তাকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে নুসরাতকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়।
আগুনে নুসরাতের শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। হাসপাতালে তার জবানবন্দি নুসরাত খুনিদের পরিচয় কিছুটা শনাক্ত করেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় চার দিন পর ৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় মারা যায় নুসরাত। ১০ এপ্রিল বিকেলে প্রায় লাখো মানুষের উপস্থিতিতে সোনাগাজী মোহাম্মদ ছাবের সরকারি মডেল পাইলট হাইস্কুল মাঠে নামাজে জানাজা শেষে তাকে কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ওই ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে ৮ এপ্রিল মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় ২৮ মে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২০ জুন অভিযোগ গঠন করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্য্যুনাল। মামলাটি মাত্র ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ সাক্ষির সাক্ষ্য ও যুক্ততর্ক গ্রহণ করা হয়। সেই বছরের ২৪ অক্টোবর দেশের আলোচিত নুসরাত হত্যার রায় ঘোষণা করেন বিচারক।
রায়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলাসহ ১৬ আসামি সকলের মৃত্যুদন্ড দেয় ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের ততকালীন বিচারক মামুনুর রশিদ। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানার দন্ডে দন্ডিত করেন।
ফেনী জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) হাফেজ আহমেদ জানান, রায় ঘোষণার পর সকল আসামি উচ্চ আদালতে আপিল করে। উচ্চ আদালত আপিল শুনানির জন্য একটি বেঞ্চ গঠন করে। তবে গেল বছর করোনার কারণে উচ্চ আদালতের কার্যক্রম সীমিত করায় মামলাটির আর অগ্রগতি হয়নি বলে আমি শুনেছি।
Leave a Reply