দুুদিন আগে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী জানান, দেশজুড়ে সোমবার থেকে শুরু হবে লকডাউন। এ ঘোষণায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এক রকম হুলুস্থুল শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাজারে দেখা গেছে বাড়তি ভিড়; অতিরিক্ত পণ্য কেনার হিড়িক। সাধারণ অনেক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল জীবিকা নিয়ে বাড়তি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অনেকেই আবার গ্রামে ফেরার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত গতকাল অনেকটা শিথিল করেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। সরকার আরোপিত এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার আগেই এ নিয়ে এক প্রকার ধোঁয়াশা তৈরি হতে দেখা গেছে গতকাল। আজ থেকে শুরু হচ্ছে সরকারের এসব নিষেধাজ্ঞা কার্যকর।
সরকার জনসাধারণের চলাচলে নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করলেও প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই খোলা রাখা হয়েছে। চালু রাখা হয়েছে একুশে বইমেলা; সিনেমা হল। অথচ বন্ধ রাখা হয়েছে গণপরিবহন চলাচল। বিষয়টি সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে অনেকটা ‘হালকা’ করে দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। বিশেষজ্ঞরাও সরকারের এ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিচ্ছেন। এদিকে নিষেধাজ্ঞাযুক্ত প্রজ্ঞাপন জারির পর আরোপিত বিধিনিষেধের প্রতিবাদে রাজধানীর ব্যবসায়ীরা রাস্তায় বিক্ষোভও করেছেন।
গতকাল রবিবার ঘোষিত ১১ দফা বিধিনিষেধে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে শর্তসাপেক্ষে সার্বিক কার্যাবলি অর্থাৎ জনসাধারণের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। তবে এই সময়ে অতি জরুরি প্রয়োজন অর্থাৎ ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকারের কাজে বাড়ির বাইরে বের হতে পারবেন জনসাধারণ। এ ছাড়া গণপরিবহন চলাচল বন্ধসহ দোকানপাট-মার্কেট, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, ৫ এপ্রিল (আজ সোমবার) ভোর ৬টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত এসব নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে। কাঁচাবাজার এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাবেচা করতে বলা হয়েছে। মহামারী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যে ১৮ দফা নির্দেশনা এসেছিল, এরই আলোকে সর্বশেষ এসব নির্দেশনা দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
সরকারের এই নিষেধাজ্ঞায় করোনা সংক্রমণ কমবে কিনা- এমন প্রশ্নে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক আমাদের সময়কে বলেন, সরকার যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছে তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। সরকারের কৌশল ও লক্ষ্য সঠিক নয়। সরকারকে আগে ঠিক করতে হবে তারা কী করবে, কীভাবে করবে এবং কতদিনে করবে। লকডাউন নাকি কারফিউয়ের মাধ্যমে করবে; তা নির্দিষ্ট করতে হবে।
মোজাহেরুল হক বলেন, যে কোনো সিদ্ধান্ত সফল করতে হলে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। নইলে তাতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তিনি বলেন, প্রথমে বলা হলো- লকডাউন। এখন বলা হচ্ছে বিধিনিষেধ। যে পদ্ধতিতেই হোক, সরকার যেভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। কারণ এক সপ্তাহ কিংবা দুই সপ্তাহ- এইভাবে সময় নির্দিষ্ট করে দিয়ে লকডাউন বা বিধিনিষেধ আরোপ করে করোনা নিয়ন্ত্রণ হবে না।
তবে সরকারের বিধিনিষেধকে কিছুটা ইতিবাচকভাবে দেখছেন ডব্লিউএইচওর উপদেষ্টা অধ্যাপক বেনজির আহমদ। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের ঘোষিত নির্দেশনা অনুযায়ী গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। ফলে মানুষের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়া কমবে। এতে সংক্রমণ কম হবে। লকডাউন করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে অবশ্যই ভূমিকা রাখবে। তবে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন বা চলাচলে বিধিনিষেধই যথেষ্ট নয়, আমরা বলছি সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে। লকডাউনে হয়তো এক স্থান থেকে আরেক স্থানে সংক্রমণ ছড়াবে না। কিন্তু বাড়ির ভেতরের সংক্রমণ কমাতে হবে, সে ক্ষেত্রে কী করা হবে তার কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বাড়ির ভেতরের সংক্রমণ কমাতে হলে নমুনা পরীক্ষা, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে। এর সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জোনিং ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যে এলাকায় সংক্রমণ বেশি, সেই এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করে বেশি বেশি মানুষকে পরীক্ষা করা, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করা, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। বিধিনিষেধ বা লকডাউন যেন মানুষের উপকারে আসে, মানুষ যেন লকডাউনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
যা যা বিধিনিষেধ মানতে হবে
এক. সকল প্রকার গণপরিবহন (সড়ক, নৌ, রেল ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট) বন্ধ থাকবে। তবে পণ্য পরিবহন, উৎপাদন ব্যবস্থা, জরুরি সেবার ক্ষেত্রে এ আদেশ প্রযোজ্য হবে না। এ ছাড়া বিদেশগামী/প্রত্যাগতদের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না; দুই. আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন- ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দর (স্থল, নৌ ও সমুদ্রবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিস এবং তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে; তিন. সকল সরকারি/আধা সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত অফিস-আদালত এবং বেসরকারি অফিস কেবল জরুরি কাজ সম্পাদনে সীমিত পরিসরে প্রয়োজনীয় জনবলকে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় অফিসে আনা-নেওয়া করতে পারবে। শিল্প-কারখানা ও নির্মাণকাজ চালু থাকবে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ শিল্প-কারখানা এলাকায় নিকটবর্তী সুবিধাজনক স্থানে তাদের শ্রমিকদের জন্য ফিল্ড হাসপাতাল ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে; চার. সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না; পাঁচ. খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় কেবল খাবার বিক্রি ও সরবরাহ করা যাবে। সেখানে বসে খাবার গ্রহণ করা যাবে না; ছয়. শপিংমলসহ অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকবে। তবে দোকানগুলো পাইকারি ও খুচরা পণ্য অনলাইনের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই কর্মচারীদের আবশ্যিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং কোনো ক্রেতা সশরীরে মার্কেটে যেতে পারবেন না; সাত. কাঁচাবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাবেচা করা যাবে। বাজার কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে; আট. ব্যাংকিং ব্যবস্থা সীমিত পরিসরে চালু রাখার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে; নয়. সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ঢাকার সুবিধাজনক স্থানে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে; দশ. সারাদেশে জেলা ও মাঠ প্রশাসন এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ নেবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত টহল জোরদার করবে এবং এগারো. এ আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনুনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ
বিধিনিষেধ ঘোষণার প্রতিবাদে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরা রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। বিক্ষোভে লকডাউন মানি না বলে সেøাগান দেন তারা। রাস্তাও অবরোধ করেন। এ ছাড়া মৌচাক মার্কেটের ব্যবসায়ীরাও সরকারের এই বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন। তারা বলেন, লকডাউন বা দোকানপাট বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে সরকার আমাদের মতো গরিবদের পেটে লাথি দিচ্ছে বারবার। দোকানপাট বন্ধ থাকলে আমাদের চলার কোনো ব্যবস্থাই থাকে না।
বইমেলা নিয়ে সমালোচনা
করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই একুশে বইমেলা চালু রাখার কঠোর সমালোচনা করছে সাধারণ মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটছে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সীমিত পরিসরে দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বইমেলা চালু রাখার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। অথচ সরকারি নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী সব প্রকার গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। একদিকে বইমেলা খোলা, অন্যদিকে গণপরিবহন বন্ধ- সরকারের এমন পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তের সমালোচনা চলছে যত্রতত্র। নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বইমেলা চালু রাখার যে প্রজ্ঞাপন, সেটি ফেসবুকে শেয়ার করে অনেককেই সমালোচনা করতে দেখা গেছে।
Leave a Reply