কক্সবাজার ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (ডিএসবি) কিছু অসাধু কর্মকর্তা। পাসপোর্ট জালিয়াত সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন কক্সবাজার পৌরসভার কয়েকজন কাউন্সিলর এবং বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরাও। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তারা রোহিঙ্গাদের দিয়ে দিচ্ছেন ভুয়া নাম-ঠিকানার জন্মনিবন্ধন। আর এসব
কাগজ দিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানিয়ে অনায়াসেই মধ্যপ্রাচ্যে, এমনকি ইউরোপে চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে। তবে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী হওয়ায় তাদের কারণে ক্ষুণœ হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের শতাধিক পাসপোর্ট পুনর্তদন্ত করে এসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও জাল-জালিয়াতির তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এসব ঘটনায় গত ২৫ মার্চ চট্টগ্রামের দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে ১২টি মামলা হয়েছে। দুদক কর্মকর্তারা বাদী হয়ে মামলাগুলো করেন। এতে কক্সবাজার সদর পৌরসভার সাবেক ও বর্তমান সাত কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদের দুই চেয়ারম্যান, ডিএসবির তিন পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর), দুই সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই), জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন আইনজীবীসহ বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা সদস্যকে আসামি করা হয়।
পুলিশ সদস্যরা হলেন- ডিএসবির সাবেক পরিদর্শক মিজানুর রহমান (বর্তমানে চট্টগ্রাম সিআইডি), সাবেক পরিদর্শক কাজী মো. দিদারুল আলম (বর্তমানে কোর্ট পরিদর্শক ব্রাহ্মণবাড়িয়া), সাবেক পরিদর্শক প্রভাষচন্দ্র ধর (বর্তমানে ডিআইজি অফিস রংপুর), বিশেষ শাখার এএসআই জাহিদুল ইসলাম (বর্তমানে রাঙামাটি পুুলিশ লাইন্স) এবং সাবেক এএসআই সাজেদুর রহমান (বর্তমানে ফেনীর ডিবিতে কর্মরত)। চেয়ারম্যানদের মধ্যে মহেশখালী কুতুবজোম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন খোকন ও সচিব প্রিয়তোষ দে এবং সদর থানা পোকখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিক আহমদ। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অ্যাডভোকেট (নোটারি পাবলিক) আবুল কালাম আজাদকেও আসামি করা হয়েছে।
কাউন্সিলরদের মধ্যে রয়েছেন- কক্সবাজার পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের (বাহারছড়া) সাবেক কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র মো. রফিকুল ইসলাম, ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মিজানুর রহমান, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আশরাফুল হুদা সিদ্দিকী জামশেদ, ১০ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সালাউদ্দিন, সাবেক কাউন্সিলর জাবেদ মোহাম্মদ কায়সার নোবেল, সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাসিমা আক্তার (বকুল) এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হুমায়রা বেগম। এর মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি মামলায় গত ২৮ মার্চ জাবেদ কায়সার নোবেল, রফিকুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান নামে সাবেক তিন কাউন্সিলরকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। তবে অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদ মোহাম্মদ সিনহা হত্যাকা-ের পর টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাসের নাম উঠে আসার পর একযোগে জেলা পুলিশের সব সদস্যকে বদলির কারণে আসামি পাঁচ পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তারের বাইরে রয়েছেন।
জানতে চাইলে একাধিক মামলার বাদী দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম ২-এর উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, ‘একজন বাংলাদেশি নাগরিক পাসপোর্ট আবেদন করতে গেলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা জন্মনিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্রে তাদের সত্যায়ন প্রয়োজন পড়ে। দরকার হয় পুলিশের ভেরিফিকেশনও। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে জাল-জালিয়াতির কাগজপত্র প্রদর্শনসহ পুলিশ সদস্যরা ভেরিফিকেশন না করেই আবেদনকারীর সব তথ্য সঠিক বলে নোট দেন। এতে বাংলাদেশি নাগরিক না হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা এ দেশের পাসপোর্ট গ্রহণ করে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারকেন্দ্রিক মানবপাচারকারী একটি চক্র রোহিঙ্গাদের বিদেশ পাঠানোর নামে তাদের কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা নেয়। প্রথমে তারা কাউন্সিলর-চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে জন্মসনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে। এর পর ভুয়া নাম-ঠিকানায় না গিয়েই ভেরিফিকেশন রিপোর্ট দেয় পুলিশ। তার জন্য দেওয়া হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার করে টাকা। এভাবে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট হয়ে যায় টাকা দিলেই।
তদন্তে উঠে আসে, কক্সবাজার সদরের উত্তর নুনিয়ারছড়া ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা পরিচয়ে ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট জেলা পাসপোর্ট কার্যালয়ে গিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন বেগম নামে এক নারী। বাবা হিসেবে হাবিবুর রহমান এবং মা আরেফা বেগমের পরিচয় দেন তিনি। সঙ্গে জমা দেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর স্বাক্ষরিত জন্মনিবন্ধন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র। পরে তথ্য ভেরিফিকেশনের দায়িত্ব পায় পুলিশ। কিন্তু দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সরেজমিনে মাঠে না গিয়েই আবেদনটি সঠিক বলে পাসপোর্ট কার্যালয়ে জবাব দেন। দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে, সানজিদার জন্মনিবন্ধন সত্যায়ন করেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান। ভুয়া বাবা-মা ও ঠিকানা সাজিয়ে নিজেকে মেয়র উল্লেখ করেও তিনি সিল ও স্বাক্ষর দেন। অথচ মিজানুর রহমান কখনো কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ছিলেন না। অন্যদিকে যে তারিখে কাউন্সিলর জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধন দেন, কাউন্সিলর কার্যালয়ের মুড়ি বইয়ে ওই তালিকায় সানজিদার নামেরও কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। দুদক বলছে, নিজের সিল ও স্বাক্ষর স্বীকার করে কাউন্সিলর মিজানুর রহমান এ ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন।
তদন্তকারী একাধিক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গারা যতগুলো পাসপোর্ট পেয়েছেন পুলিশ সদস্যরা সেসব ঠিকানায় সরেজমিনে যাননি। মোটা অংকের টাকা পেলেই এগুলো সঠিক বলে চালিয়ে দেন তারা। এ ছাড়া নোটারি পাবলিক আইনজীবী আবুল কালাম আজাদ রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধনে সত্যায়ন করেন। এভাবে প্রতিটি ধাপে জাল-জালিয়াতির কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেয়ে যায়। আর তা দিয়ে পাড়ি জমায় বিদেশে।
Leave a Reply