এক বছর আগে ৮ মার্চের এ দিন ছিল রোদ্রোজ্জ্বল, পরিষ্কার নীল আকাশ। ওইদিনের সূর্য যখন ঠিক মাথার ওপরে তখনই আকাশ ভেঙে পড়ার মতো খবর দিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জানাল বাংলাদেশে তিনজনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। সেই খবরে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে দেশ। তারপর ভাইরাসের ভয়ানক বিভীষিকায় দেশের মানুষ দীর্ঘদিন দমবন্ধ অবস্থায় ছিল। করোনায় যেন অবধারিত মৃত্যু- এমন আতঙ্ক মানুষের মাঝে বিষণœতা আর অবসন্ন অবস্থা তৈরি করে। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ বেঁচে থাকার যুদ্ধ শুরু করে। সরকার ঘোষিত লকডাউনে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ঘরবন্দি হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সরকারি-বেসরকারি সব অফিস-আদালত। এক বছর পর এখন অবশ্য সেই অবস্থা নেই। মৃত্যুশোককে পেছনে ফেলে নতুন করে বাঁচার লড়াইয়ে নেমেছে মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে- পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণেই
আছে।
গত একটি বছর এমনভাবে কেটেছে যার কোনো কিছুই স্বাভাবিক ছিল না। ২০২০ সালের শুরুটা যেভাবে হয়েছিল, সেই গতি দিক হারিয়েছে ৮ মার্চে। তারপর থেকে এতদিনেও দেখা যায়নি শিশুদের দল বেঁধে বিদ্যালয় যাওয়ার দৃশ্য। স্মরণকালে দেখা যায়নি যে দেশে ঈদ, পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবস- স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে গিয়ে পালন করতে হয়েছে। এভাবে এত গুণীজন, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে হারানোর বেদনায় নীল হয়নি দেশ। মাস্কে ঢাকা মুখই ছিল পুরো দেশের চিত্র, যেখানে মানুষ ঘরবন্দি দশা থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনারত ছিল।
এতকিছুর পরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে মানুষের আশা জাগিয়েছে টিকা। বাংলাদেশে এখন অক্সফোর্ডের টিকা দেওয়া হচ্ছে। এই টিকা গ্রহণের ফলে করোনা সংক্রমণ আরও কমে আসবে। বছর শেষে হয়তো করোনা জয়ের কাছাকাছি থাকবে দেশ।
করোনা জয় করার আশাজাগানিয়া খবরের পরও দেশ যে এখনো করোনামুক্ত নয় তা মানুষকে মনে রেখে সতর্ক হয়ে চলতে বলেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। মানুষের ঢিলেমিভাবে যে কোনো সময় পরিস্থিতি কঠিন করে তুলতে পারে। টিকা দেওয়া হলেও বিশাল জনগোষ্ঠীর তুলনায় তা অনেকটাই কম। আর টিকা দেওয়ার পরও যে করোনায় আক্রান্ত কেউ হবেন না, তাও নিশ্চিত করেননি পৃথিবীর কোনো স্বাস্থ্য বিভাগ। সম্প্রতি করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। বিষয়টি মাথায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
২০১৯ সালের শেষদিকে চীনের উহানে প্রথম করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। ৮ মার্চ প্রথম দেশে করোনা আক্রান্ত তিন রোগী শনাক্ত হন। ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। পরদিন দেশের মানুষ প্রথম ‘লকডাউন’ দেখতে পায় মাদারীপুরের শিবচরে। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় সাধারণ ছুটি, শেষ হয় ৩০ মে। গণপরিবহন চলাচল শুরু হয় ১ জুন। ৬৬ দিন পর সচল হয় দেশ।
দেশে সংক্রমণ শুরুর দিকে রোগী শনাক্তের হার কম ছিল। গত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এর পর থেকে নতুন রোগীর পাশাপাশি শনাক্তের হারও কমতে শুরু করেছিল। মাস দুয়েক সংক্রমণ নিম্নমুখী থাকার পর গত নভেম্বরের শুরুর দিক থেকে নতুন রোগী ও শনাক্তের হারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয়। ডিসেম্বর থেকে সংক্রমণ আবার কমতে শুরু করে। তবে তিন সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ আবার ঊর্ধ্বমুখী। এরই মধ্যে কয়েক শতবার রূপ বদল করেছে প্রাণঘাতি এই ভাইরাস। করোনা ভাইরাস মহামারী মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে দেশেও নেওয়া হয় নানা ধরনের কার্যক্রম। গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে জুলাইয়ের প্রথম ভাগ পর্যন্ত লকডাউনের আদলে সাধারণ ছুটি থাকায় মানুষের চলাচল, পরিবহন, ব্যবসাবাণিজ্য, অফিস-আদালত সব ক্ষেত্রেই অচলাবস্থা চলে।
গতকাল রবিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, দেশে সংক্রমণ শনাক্তের এক বছরের মাথায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৫ লাখ ৫০ হাজার ৩৩০ জনে। ৮ হাজার ৪৬২ জনর মৃত্যু হয়েছে।
করোনা শনাক্তের প্রথম দিকে এই মহামারী মোকাবিলায় বেশ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তখন পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ তৈরি হয়েছে, নানা গুজবে মানুষ মৃত মানুষের সৎকারেও কাছে যায়নি। বাড়ি বাড়িতে লাল পতাকা নিয়ে করোনার বাড়ি শনাক্ত করে তাদের ‘আটকে’ রাখা হয়। ব্যস্ত শহর রূপ নেয় জনমানবশূন্য নগরীতে, তৈরি হয় এক এক ভুতুড়ে পরিবেশ। পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় চিকিৎসকরাও এ রোগের চিকিৎসা দিতে ভীত ছিলেন।
দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও করোনার চিকিৎসা দুটোই ছিল চ্যালেঞ্জিং। করোনার সংক্রমণের প্রথমদিকে রোগী শনাক্ত, রোগীর সংস্পর্শে আসা মানুষদের খুঁজে বের করে পরীক্ষা করা, আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে হাসপাতাল স্বল্পতাসহ সব ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল। এ ছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তাসামগ্রী মাস্ক, পিপিই, সংক্রমণ ভয়ে দেশের বিশেষজ্ঞদের প্রাইভেটগুলো চেম্বার বন্ধ করে দেওয়া হয়। চিকিৎসাসেবা দূরে থাকে বেসরকারি হাসপাতালগুলো। ফলে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের নেয়া সব পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হয়নি।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক ডা. এসএম আলমগীর বলেছেন, করোনার সংক্রমণের প্রথম দিকে সব পর্যায়ের মানুষের মধ্যে একটা ভীতি ছিল, আমাদের যারা চিকিৎসক ছিলেন তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ছিল। শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই করোনা নিয়ে ভীতি কাজ করেছে। করোনা একটি নতুন ভাইরাস, কেউই এই ভাইরাসের সাথে পরিচিত ছিল না, এর কোনো টিট্রমেন্ট জানা ছিল না। আইইডিসিআর ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান পিপিইর প্রয়োজন ছিল না। সব মিলিয়ে করোনার সংক্রমণ ও নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়েছে। এগুলো কাটিয়ে উঠতে একটু সময় লেগেছে। আমাদের দেশে করোনা ম্যানেজমেন্ট খুবই ভালো।
তিনি বলেন, করোনার ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা (একজন কতজন সংক্রিমত করতে পারা) এক সময় ২ শতাংশের বেশি ছিল। এখন এটি কমে শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশে নেমে এসেছে। বর্তমানে দেশে কোভিড-১৯ টিকা প্রদান শুরু হয়েছে। করোনার টিকা নিলে মৃত্যু কমে শূন্য পর্যায়ে নেমে আসার কথা এবং করোনা হলে সেসব জটিলতা হয় সেগুলো শূন্যের কোটায় নেমে আসার কথা। মৃত্যুঝুঁকি কমে যাবে। ফলে হসপিটালে রোগী সংখ্যাও কমে যাবে। এর ফলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর যে চাপ আগের মতো থাকবে না।
অবশ্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, করোনার সংক্রমণ দীর্ঘসময় ধরে চলছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সংক্রমণ কিছুটা কমলেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এরপর আবার বেড়েছে। এর পর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সংক্রমণ কমেছে। এই মাসের শুরু থেকে সংক্রমণ হার কিছুটা বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। কারণ এখনো যারা সেন্টারের আসছে তাদেরই পরীক্ষা হচ্ছে। যারা লক্ষণ-উপসর্গ নিয়েও সেন্টারে যাচ্ছে না। করোনার প্রকৃত চিত্র জানতে হলে যেখানে সংক্রমণ হচ্ছে এবং যেখানের লোক মারা যাচ্ছে সেখানকার টেস্ট বাড়াতে হবে। এটি বাংলাদেশে হচ্ছে না। করোনার সংক্রমণ বাড়ার কারণ হলো মানুষের মধ্যে গা-ছাড়া ভাব। আবার মাস্ক পরা ছেড়ে দেওয়াসহ স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিষয়টিও আছে। একই সঙ্গে সরকারও করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
তবে করোনার সময় কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনাও হয়েছে। ভুয়া হাসপাতাল, করোনা টেস্টের নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদ, জেকেজির ডা. সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফুর রহমানসহ নকল মাস্ক ও পিপিই সরবরাহ এবং আরও বেশকিছু করোনাকেন্দ্রিক অপরাধে জড়িত থাকায় অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নানা পদক্ষেপের ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই দেশ আবার স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে আসতে শুরু করে। ২৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ওই টিকা দেশের মানুষের শরীরে প্রয়োগ করার উদ্বোধন করেন। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে গণটিকাদান শুরু হয়। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারকে এরই মধ্যে সাফল্যের কৃতিত্ব দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আরও একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা। গতকাল সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশে টিকা গ্রহণকারীর সংখ্যা ৩৭ লাখ ৮৯ হাজার ৩৫২ জন। গতকাল দুপুরে পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন ৫০ লাখ ৩ হাজার ২৪৮ জন।
Leave a Reply