মাদককারবারিদের কাছ থেকে জব্দ করা ইয়াবা-ফেনসিডিল বিক্রি করে দিতেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) একজন পরিদর্শক। তিনি নিয়মিত ইয়াবাও সেবন করতেন। চোরাকারবারিদের সঙ্গে সখ্যের বিস্তর অভিযোগ রাজশাহী বিভাগের একটি জেলার ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। শুরু হয় বিভাগীয় তদন্ত। তদন্তকারীদের সুপারিশে ডিএনসির ল্যাবে তার মাদকগ্রহণের বিষয়টি শনাক্তে ডোপ টেস্ট করা হয়। কিন্তু টেস্টে রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। কীভাবে এটি সম্ভব হলো? ল্যাবসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু মাদকগ্রহণ ও পরীক্ষার সময়ের হেরফের করতে পারলেই ডোপ টেস্টকেও ফাঁকি দেওয়া সম্ভব।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, অভিযুক্ত ওই পরিদর্শকের ডোপ টেস্টে রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও আগে মাদকগ্রহণ, চিকিৎসার ইতিহাস বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে তিনি একজন ইয়াবাসেবী। এ কারণে বিভাগীয় ব্যবস্থা হিসেবে ইতোমধ্যে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তবে ডোপ টেস্ট বা মাদকগ্রহণের অভিযোগ চ্যালেঞ্জ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর আপিল করেছেন ওই কর্মকর্তা।
ডোপ টেস্ট তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেউ এক হাজার ন্যানোগ্রামের বেশি এমফিটামিন বা ইয়াবা সেবনের তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে ডোপ টেস্ট করালেই কেবল তার বিরুদ্ধে পজিটিভ (সেবনকারী প্রমাণিত) রিপোর্ট আসবে। নির্দিষ্ট এই সময়ের মধ্যে এক হাজার ন্যানোগ্রামের কম ইয়াবা সেবন করলে ডোপ টেস্টেও ধরা পড়বে না। আবার সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে এই সময়ের মধ্যে ডোপ টেস্ট না করালে বা তিনি ওই সময়ে মাদক গ্রহণ না করলে মাদকসেবী প্রমাণের সুযোগ খুবই কম।
ডিএনসি থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে মাদকাসক্ত প্রায় ৭০ লাখ। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন। পেশাজীবীদের মধ্যেও মাদক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে শৃঙ্খলা বিঘিœত ও কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ডোপ টেস্টের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করলে যুবসমাজের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় সভাপতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, সরকারি চাকরিতে সব নিয়োগে কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রত্যেকের ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা করা হবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও ডোপ টেস্ট চালু করা হবে। যারা চাকরিতে আছেন তাদের বিরুদ্ধে মাদকগ্রহণের অভিযোগ পাওয়া গেলে তাদেরও ডোপ টেস্ট করা হবে। এই কার্যক্রম ব্যাপক হারে প্রয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
তবে ডোপ টেস্টসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত এখন যাদের ডোপ টেস্ট করা হয়, তাদের নির্দিষ্ট সময়ে ফরেনসিক ল্যাবে হাজির হতে বলা হয়; যা সময়সাপেক্ষ। এতে একজন মাদকসেবী গাঁজা ছাড়া অন্যসব মাদক সেবন বন্ধ করলে তাদের শনাক্তের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফলে বর্তমান পদ্ধতিতে ডোপ টেস্ট করলে সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকার স্ট্যান্ডার্ড মানলে এবং অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে চুল, লোম, নখ থেকে নমুনা সংগ্রহ করলে সেবনকারীর শরীরে এক মাসের বেশি সময় ইয়াবা এবং তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত গাঁজার অস্তিত্ব পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া বর্তমান পদ্ধতিতেও সন্দেহভাজনদের বুঝে ওঠার আগেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডোপ টেস্টের আওতায় আনা উচিত।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) কৃষ্ণপদ রায় আমাদের সময়কে বলেন, যেসব পুলিশ সদস্য মাদক সেবন করছে বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ দেখা দেয়, তখন তাদের নজরদারিতে রাখা এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় ডোপ টেস্টের আওতায় আনা হয়। ডোপ টেস্টের রিপোর্টে মাদকগ্রহণের বিষয়টি প্রমাণিত হলে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় নিরাময় কেন্দ্র; রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের (সিপিএইচ) ফরেনসিক ল্যাবসহ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডোপ টেস্ট করা হয়। আদালতের নির্দেশ বা সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের চাহিদা অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠান মূলত মূত্র, রক্ত, মুখের লালা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। তবে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের ল্যাবে শুধু মূত্রের নমুনা গ্রহণ করা হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিভাগ ও পুলিশের ল্যাবসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়াবার মতোই এক হাজার ন্যানোগ্রামের বেশি হেরোইন, মরফিন, কোডিন গ্রহণের তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে ডোপ টেস্ট করলে পজিটিভ রিপোর্ট আসবে। গাঁজা বা ভাং সেবনের তিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তা ধরা পড়বে। তবে মদ বা অ্যালকোহলজাতীয় দ্রব্য সেবনের ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পর শনাক্তের সম্ভাবনা কম।
গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের ফরেনসিক ল্যাবে ডোপ টেস্ট চালু হয়। এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেখানে টেস্ট করানো হয়েছে ১ হাজার ৬৩৮ জনকে। তাদের মধ্যে ১২৬ জনের পজিটিভ আসে। আর পজিটিভ আসা ব্যক্তি বা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ৮৬ জনই ইয়াবা সেবনকারী।
কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) ডা. মো. এমদাদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাদের মাদকসেবী হিসেবে সন্দেহ করা হয় তাদেরই এখানে আনা হয়। তিনি বলেন, ইয়াবার উপাদান রক্তের সঙ্গে মেশে না। এ কারণে মূত্রের নমুনা গ্রহণের মাধ্যমেই ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪৯৪ জন, ২০২০ সালে করোনার প্রথম তিন-চার মাস ছাড়া ৮৩৫ জন এবং এ বছরের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় নিরাময় কেন্দ্র ল্যাবে ৫২ জনের ডোপ টেস্ট করা হয়। এতে ৯০ শতাংশ ব্যক্তির শরীরে মাদকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। যাদের বেশিরভাগই নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নেওয়া। মাদকগ্রহণকারীদের মধ্যে সর্বাধিক ইয়াবা সেবনসহ গাঁজা, ইনজেকশন নেওয়ার হার বেশি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিরাময় কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা বলেন, ডোপ টেস্টে শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে, যার পজিটিভ এসেছে তিনি মাদকসেবী। আবার পরিমাণে কম সেবনকারী এবং নির্দিষ্ট সময়ের আগে চালাকি করে কেউ মাদকসেবন বন্ধ করলে তার রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে। বিশেষ করে একজন মাদকসেবী ১৫ দিন ধরে ইয়াবা সেবন না করলে কোনোভাবেই ডোপ টেস্টে তার পজিটিভ আসবে না। তবে ডোপ টেস্টের পাশাপাশি যারা মাদকগ্রহণের পর চিকিৎসা নিয়েছেন, আচরণগত সমস্যা রয়েছে ইতিহাস দেখে এমন ব্যক্তিদের মাদকগ্রহীতা নিশ্চিত বলা যেতে পারে।
মাদকদ্রব্যের রাসায়নিক পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মদ বা অ্যালকোহলের উপাদান শরীর থেকে বিনষ্ট হয়। এ জন্য উন্নত বিশ্বে এবং বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোয় ব্রেথ এনালাইজার ব্যবহার করা হয়। এটাও মাদক পরীক্ষাসংশ্লিষ্টদের কাছে সহজলভ্য নয়। ফলে সরকার ডোপ টেস্টে জোর দিলেও পরীক্ষায় জটিলতা রয়েই গেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নিরাময় কেন্দ্রের রেসিডেন্ট সাইকিয়াটিস্ট ডা. কাজী লুতফুল কবীর আমাদের সময়কে বলেন, মাদক সেবনের তিন-চার দিন পর মাদকসেবীকে আনা হলে গাঁজা ছাড়া কোনোটাতেই পজিটিভ পাওয়া যায় না। আবার যে স্ট্রিপে গুণগত পরীক্ষা করা হয়, তা-ও চ্যালেঞ্জে টিকবে না। এ ক্ষেত্রে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে জোর করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিয়ে এলে প্রমাণ পাওয়া সম্ভব।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদক অনুবিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, ডোপ টেস্টে মাদকসেবী শনাক্তের পর পুলিশ বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের যে কজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে এটি বিভাগীয় ব্যবস্থাস্বরূপ। কিন্তু দেশে যে ডোপ টেস্ট হচ্ছে তার আইনগত কোনো বৈধতা নেই। এ জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটি খসড়া প্রস্তাবনা পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। খসড়ায় কিছু সংশোধন আনতে ফাইল ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সারাদেশে ১০টি ফরেনসিক ল্যাব করার প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার বলেন, সরকার মাদকের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতিতে আছে। এ জন্য আমরাও চাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কেউ যাতে মাদক সেবনে বা বিক্রিতে জড়িয়ে না পড়ে। ইতোমধ্যে একজন পরিদর্শককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ডোপ টেস্ট নিয়ে আইন প্রণয়ন এবং আধুনিক ফরেনসিক ল্যাব চালু হলে জটিলতা থাকার কোনো সুযোগ নেই।
Leave a Reply