দেশে ভারী ও মধ্যম শ্রেণির গাড়ির তুলনায় ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা অপ্রতুল। তাই পেশাদার চালক বাড়াতে লাইসেন্সের শর্ত শিথিল করেছে সরকার। সংশোধিত সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, হালকা ড্রাইভিং লাইসেন্সধারীদের এক বছর পার হলেই মিলবে ভারী মোটরযানের লাইসেন্স। একই সুবিধা পাবেন মধ্যম শ্রেণির আবেদনকারীরাও। আর এ সুবিধা থাকবে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত। শর্ত শিথিলের পর আবেদনের হিড়িক পড়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে। কিন্তু ডেটা সরবরাহের জটিলতায় মিলছে না কাঙ্ক্ষিত লাইসেন্স।
জানা যায়, সাধারণত হালকা শ্রেণির লাইসেন্স পাওয়ার তিন বছর পর মধ্যম শ্রেণিতে পরিবর্তন করতে হয়। এরও তিন বছর পর সেটি ভারী লাইসেন্সে রূপান্তরের সুযোগ মিলে। আপাতত সরকারের শর্ত শিথিলের পর ছয় বছরের পরিবর্তে এক বছরেই মিলবে ভারী লাইসেন্স। বর্তমানে লাইসেন্সের উপযোগী ৮ লাখ ১৩ হাজারেরও বেশি আবেদন জমা আছে। তাদের ড্রাইভিং পরীক্ষায় পাসের পর ডেটা এন্ট্রি করে রাখে বিআরটিএ নিযুক্ত ভেন্ডর টাইগার আইটি।
কিন্তু চুক্তির বাড়তি কাজ দেখিয়ে সেই তথ্য দিতে চাইছে না আইটি প্রতিষ্ঠান। সমস্যা সমাধানে বেশ কয়েক মাস চিঠি চালাচালি করেও কোনো লাভ হয়নি। ফলে শর্ত শিথিল করেও মিলছে না পেশাদার চালকের লাইসেন্স। ঝুলে গেছে চালক সংকট দূর করতে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ। পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ে ডাইভিং লাইসেন্স না পেয়ে সরকারি-বেসরকারি চাকরি এবং বিদেশযাত্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক গ্রাহক।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, যানবাহনের ড্রাইভিং লাইসেন্সের তথ্য লার্নারের মাধ্যমে বিএসপি-বিআরটিএ সার্ভিস পোর্টালে থাকে। সেগুলো ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই যুক্ত হওয়ার কথা। সেখানে সাধারণ ড্রাইভিং লাইসেন্সের তথ্য থাকলেও সংরক্ষিত নেই সরবরাহের অপেক্ষায় থাকা আবেদনের তথ্য। তাই চালকদের জমা দেওয়া আবেদনের তথ্য যাচাই করতে পারছে না বিআরটিএ। এমন বাস্তবতায় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে মধ্যম ও ভারী লাইসেন্সের শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন নেওয়া হলেও লাইসেন্স পাচ্ছেন না পেশাদার চালকরা।
ডেটা সরবরাহ না করার যুক্তি হিসেবে টাইগার আইটি বলছে, বিআরটিএর সঙ্গে তাদের ১৫ লাখ লাইসেন্স মুদ্রণের চুক্তি হয় ২০১৬ সালের ২৩ জুন। তাদের কার্ড সরবরাহ প্রায় শেষ। অতিরিক্ত ডেটা সরবরাহ চুক্তিতে নেই। সে কারণেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও বায়োমেট্রিকসের পরও লাইসেন্স নবায়নে ডেটা সরবরাহ করা হচ্ছে না। তাই চুক্তির অতিরিক্ত ডেটা এন্ট্রির আবেদনের জন্য একাধিকবার বিল দাবি করে বিআরটিএকে চিঠি দিয়েছে টাইগার আইটি। তবে বিআরটিএ বলছে, তথ্য সরবরাহ চুক্তির অতিরিক্ত কাজ নয়; পাঁচ বছর মেয়াদি কাজেরই অংশ। চুক্তির ধারা পিজি৪-৩ডি এবং ৩এ অনুযায়ী অতিরিক্ত বিল দিতে হবে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কেবল লাইসেন্স নয়, রাইডশেয়ারিংয়ে চালকের তথ্য যাচাইয়েও সমস্যা হচ্ছে একই কারণে। দফায় দফায় চিঠি দিয়েও প্রতিকার পায়নি বিআরটিএ। তাই রাইডশেয়ারিং, বিএসপি কার্যক্রম এক প্রকার বন্ধই রয়েছে। এ সম্পর্কিত বৈঠকে বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলেন, লাইসেন্স সিস্টেম সম্পর্কিত সফটওয়্যার, ডেটা ও হার্ডওয়্যার বিআরটিএর সম্পত্তি। চুক্তির আওতায় সরবরাহকৃত লোকবল পাঁচ বছরের জন্য নির্ধারিত। তাই অতিরিক্ত বিল দাবির বিষয়টি অযৌক্তিক।
বৈঠকে কর্মকর্তারা আরও বলেন, পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের যোগ্যতা শিথিল করলেও সিস্টেম অপশন না রাখার কারণে লাইসেন্স ইস্যু করা যাচ্ছে না। গত বছরের মার্চ থেকে এ নিয়ে ই-মেইেলে এবং চিঠিতে যোগাযোগ করেও লাভ হয়নি। বিভিন্ন সার্কেল অফিসে লাইসেন্সের জন্য ‘ডেটা এন্ট্রি প্যানেল’, ‘প্রুফ প্যানেল’ ও ‘অ্যাপ্রোভাল’ ইউজার আইডি ইনঅ্যাক্টিভ অথবা লকড রয়েছে। তাই গ্রাহকসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে।
নানা ঘটনা শেষে মাদ্রাজ প্রিন্টার্স লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বিআরটিএ। প্রতিষ্ঠানটি পাঁচ বছরে ৪০ লাখ লাইসেন্সের কার্ড সরবরাহ করবে। দিনে দেবে ৮ হাজারেরও বেশি লাইসেন্স। প্রতিষ্ঠানটি তাদের ভেন্ডর প্রজেক্ট ইনিশিয়েশন ডকুমেন্ট (পিআইডি) জমা দিয়েছে গত ২৯ সেপ্টেম্বর। সে অনুযায়ী, ডিসেম্বরের মধ্যে কার্ড সরবরাহে যাওয়ার কথা ছিল তাদের। কিন্তু এখনো যন্ত্রপাতি আমদানিই শেষ হয়নি। এ নিয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘কোভিডের কারণে অনেক কাজই পরিকল্পনামাফিক বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। তবু চেষ্টা করা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যেই পুরোপুরি অপারেশনে যেতে পারব।’
শর্ত শিথিলের পরও পেশাদার লাইসেন্স জটিলতা প্রসঙ্গে বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আগের চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তথ্য পাওয়া নিয়ে বৈঠক হয়েছিল। তারা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বিকল্প পন্থায় এর সমাধান হয়েছে। তাই এ নিয়ে এখন আর সমস্যা নেই বলতে পারেন।’
বিআরটিএর সার্কেল অফিসের মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ডেটা ট্রান্সফারের অভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স আর রাইডশেয়ারিংয়ের অনেক কাজ ঝুলে আছে। তাই ম্যানুয়ালি কিছু সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে। নতুন প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি অপারেশনে গেলে হয়তো এর সমাধান হয়ে যাবে। তবে আপাতত পেশাদার চালকের লাইসেন্স নিয়ে বিপাকে আছেন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা।
বর্তমানে সারাদেশে ৪০ লাখ ৭২ হাজার ৬১৬টি লাইসেন্স আছে। এর মধ্যে ভারী যান চালনার লাইসেন্স ১ লাখ ২ হাজার; মাঝারি মানের ১৫ হাজার ৪৭১টি ও হালকা যানের লাইসেন্স রয়েছে ১২ লাখ ১ হাজার ৫৬টি, এর মধ্যে অপোশাদার ১০ লাখ। এ ছাড়া মোটরসাইকেল, থ্রি হুইলার ও অন্যান্য কাটাগরির লাইসেন্স রয়েছে। ইতোমধ্যে ২৭ লাখ ২৩ হাজার ৬৫৬টি কার্ড ছাপিয়ে লাইসেন্সধারীদের সরবরাহ করা হয়েছে।
Leave a Reply