আওয়ামী লীগের সাংসদ হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে করা দুই মামলায় আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট (চূড়ান্ত প্রতিবেদন) দাখিল করেছে পুলিশ। এতে আসামির দায়মুক্তির আবেদন করা হয়েছে, যা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তা ফাইনাল রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন, ‘তদন্তে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি যে উদ্ধারকৃত আগ্নেয়াস্ত্রটি (পিস্তল) ইরফান সেলিমের এবং মাদক ও মদ তার। যে কক্ষ থেকে পিস্তলটি জব্দ করা দেখানো হয়েছে; সেই কক্ষে অনেক মানুষ যাতায়াত করে। ওই অবৈধ পিস্তলটি কার তা তদন্ত করে বের করা যায়নি।’ পিস্তলটির মালিক তবে কে? কে রেখেছিল হাজী সেলিমের বাসার চতুর্থ তলার কক্ষে এ অবৈধ অস্ত্রটি? কেন রেখেছিল? সঙ্গত কারণেই এমন সব প্রশ্ন জেগেছে। কিন্তু জবাব মেলেনি।
মামলা দুটির ফাইনাল রিপোর্টে এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা তথ্যগত ভুল বা ঘটনার ভুল বলে উল্লেখ করেছেন। এ কারণ দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ইরফান সেলিমকে অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি চাওয়া হয়েছে। তবে ইরফান সেলিমের দেহরক্ষী জাহিদুল মোল্লার বিরুদ্ধে হওয়া অস্ত্র ও মাদক আইনের অন্য দুটি মামলায় অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় তাকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ইরফান সেলিম ও জাহিদুল মোল্লার বিরুদ্ধে ওই চারটি মামলা করেছিলেন র্যাব ৩-এর ডিএডি মো. কাইয়ুম ইসলাম।
অস্ত্র ও মাদকের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মো. ওয়ালিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, অস্ত্র ও মাদক ইরফান সেলিমের পজিশন থেকে উদ্ধার হওয়ার কোনো প্রমাণ মেলেনি। তা ছাড়া অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণেও প্রমাণিত না হওয়ায় দুই মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১)-এর ২৪(ক) ধারায় করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- ঘটনাস্থলটি মোহাম্মদ ইরফান সেলিমের ব্যক্তিগত শয়নকক্ষ নয়। ব্যক্তিগত শয়নকক্ষের পাশের একটি অতিথি কক্ষ। মোহাম্মদ ইরফান সেলিমের পরিবার একটি রাজনৈতিক পরিবার, বিধায় ওই অতিথি কক্ষে বিভিন্ন আগন্তুক অতিথি, রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং এলাকার সাধারণ জনগণ ৩০নং ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর গ্রেপ্তারকৃত অভিযুক্ত ইরফান সেলিমের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ করার জন্য অতিথি কক্ষে আসেন। যেহেতু ইরফান সেলিম ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য মো. হাজী সেলিমের উত্তরসূরি এবং বর্তমান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০নং ওয়ার্ডের ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তিনি দীর্ঘ সময় বিদেশে থেকে পড়ালেখা করেছেন। সর্বশেষে ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত হাডসন ইউনিভার্সিটি কানাডা থেকে বিবিএ পড়াশোনা শেষ করেছেন। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করার জন্য এবং সমাজে তার সুনাম ক্ষুণœ করাসহ সমাজে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য অসৎ উদ্দেশ্যে কে বা কারা অত্র মামলার জব্দকৃত বিয়ার অভিযুক্ত ইরফানের ২৬নং চান সর্দার দাদাবাড়ির চতুর্থতলার অতিথি কক্ষে এবং জব্দকৃত বিদেশি মদ ওই ভবনের পঞ্চমতলার কক্ষে রেখেছেন তার কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া অত্র মামলায় জব্দকৃত আলামত বিদেশি মদ ও বিয়ারের বিষয়ে বাদী মামলার এজাহারে এবং জব্দ তালিকায় বর্ণিত বিদেশি মদ ও বিয়ার কার দেখানো মতে জব্দ করা হয়েছে তা এজাহারে ও জব্দ তালিকার কোথাও উল্লেখ করেননি। গোপন ও প্রকাশ্য তদন্তে, গৃহীত সাক্ষ্যপ্রমাণ ও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় অভিযুক্ত মোহাম্মদ ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬ (১)-এর ২৪(ক) ধারার অপরাধ সাক্ষীদের সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রমাণিত হয়নি।
অন্যদিকে ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ১৯-এ ধারায় ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- মামলার বাদী এজাহার ও জব্দ তালিকায় মামলার ঘটনাস্থলটি এজাহারে গ্রেপ্তারকৃত অভিযুক্ত মোহাম্মদ ইরফান সেলিমের ব্যক্তিগত শয়নকক্ষ উল্লেখ করলেও মামলাটি সরেজমিন তদন্তকালে সাক্ষ্যপ্রমাণে দেখা যায় যে, অত্র মামলার ঘটনাস্থলটি গ্রেপ্তারকৃত মোহাম্মদ ইরফান সেলিমের ব্যক্তিগত শয়নকক্ষ নয়। এটি ইরফান সেলিমের ব্যক্তিগত শয়নকক্ষের পাশের একটি অতিথি কক্ষ। ইরফান সেলিমের পরিবার একটি রাজনৈতিক পরিবার, বিধায় ওই অতিথি কক্ষে বিভিন্ন অতিথি, রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং ৩০নং ওয়ার্ডের সাধারণ জনগণ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন।
তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করার জন্য এবং সমাজে তার মানসম্মান ক্ষুণœ করাসহ সমাজে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য অসৎ উদ্দেশ্যে কে বা কারা জব্দকৃত অস্ত্র পিস্তলটি মোহাম্মদ ইরফান সেলিমের ২৬নং চাঁন সর্দার দাদাবাড়ির চতুর্থতলার অতিথি কক্ষে রেখেছেন, তার কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ইরফান সেলিমের ইতিবৃত্ত পর্যালোচনায় অত্র এলাকায় তার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র বহন/প্রদর্শন তথা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে অংশগ্রহণের কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণও পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া জব্দকৃত আলামত পিস্তলের বিষয়ে মামলার বাদী মামলার এজাহারে এবং জব্দ তালিকায় কার অস্ত্র এবং কার দেখানো মতে জব্দ করা হয়েছে তা এজাহারের কোথায়ও উল্লেখ করেননি।
গত বছরের ২৫ অক্টোবর রাতে রাজধানীর ধানমন্ডিতে হাজী মোহাম্মদ সেলিমের ‘সংসদ সদস্য’ লেখা সরকারি গাড়ি থেকে নেমে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধর করা হয়। পর দিন এ ঘটনায় ইরফানসহ আরও চারজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ২-৩ জনকে আসামি করে ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন নৌবাহিনীর ওই কর্মকর্তা। ২৬ অক্টোবর দুপুর থেকে র্যাব সদস্যরা রাজধানীর চকবাজারের ২৬ দেবীদাস ঘাট লেনে ‘চাঁন সর্দার দাদাবাড়িতে অভিযান চালান। অভিযানের পর র্যাব জানায়, হাজী সেলিমের বাসা থেকে বিদেশি পিস্তল, গুলি, একটি এয়ারগান, ৩৭টি ওয়াকিটকি, ১০ ক্যান বিয়ার, একটি হাতকড়া, একটি ড্রোন, ৪০৬ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, বিদেশি মদ ও বিয়ার পাওয়া গেছে। এ ছাড়া র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ইরফান সেলিমকে দেড় বছর ও তার দেহরক্ষীকে এক বছর কারাদ- দেন। পরে অস্ত্র ও মাদক আইনে দেহরক্ষীসহ ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করে র্যাব।
ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষীর বিরুদ্ধে করা র্যাবের মামলার এজাহারে বলা হয়েছিল- গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পুরান ঢাকায় ইরফানদের বাড়িতে সেই অভিযান চালানো হয়। ভবনের চতুর্থ তলা থেকে জাহিদুল মোল্লাকে একটি বিদেশি পিস্তল ও ৪০৬টি ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। আর চতুর্থ তলার অপর একটি কক্ষ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল এবং ইরফান সেলিমের কক্ষ থেকে ১২টি বিয়ারের ক্যান উদ্ধার করা হয়।
Leave a Reply