সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে ভিন্ন কৌশলে একটি জাতীয় ঐক্যের প্ল্যাটফরম তৈরিতে কাজ করছে বিএনপি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বিরোধীদের ‘অভিন্ন’ দাবিগুলো সমন্বয় করে এই প্ল্যাটফরম গঠন করা হচ্ছে। এর নাম হিসেবে ‘জাতীয় ঐক্যের সনদ’, ‘জাতীয় ঐক্যের রূপরেখা’, ‘জাতীয় ঐক্যের দাবি ও লক্ষ্য’ এবং ‘জাতীয় ঐক্য অর্জনের প্রস্তাবনা’- এর যে কোনো একটি চূড়ান্ত করা হতে পারে। এখান থেকেই বিরোধী দলগুলোর মূল বক্তব্য প্রস্তাবনা আকারে জাতির সামনে তুলে ধরা হবে। এ ক্ষেত্রে আগের মতো ২০-দলীয় জোট বা ঐক্যফ্রন্টের মতো দেনদরবার করে কোনো জোট করতে হবে না।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, দেশে গণতন্ত্র নেই। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে, তাতে ভোট আগের রাতেই হয়েছে। ফলে এটি কোনো নির্র্বাচনই নয়। এটি এখন প্রমাণিত এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। এ অবস্থায় দেশের সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রামের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করতে চায় বিএনপি।
এ প্ল্যাটফরমটি গড়ার ধরন একটু আলাদা হবে। নিজ দলসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের অভিন্ন দাবিগুলো একত্রিত করে একটি চূড়ান্ত প্রস্তাবনা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে এবং একাধিক নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা একটি খসড়া প্রস্তাবনা প্রস্তুত করেছেন।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, খসড়া প্রস্তাবনায় রয়েছে- অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ; জাতীয় সংসদ বাতিল; রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন; বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘অবৈধ’ শাস্তি প্রত্যাহার এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের বানোয়াট মামলা প্রত্যাহার ও সবরকম হয়রানি বন্ধ; গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তার বিধান এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা; বাক ব্যক্তি সংবাদমাধ্যম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশসহ সব কর্মসূচি পরিচালনার স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বাতিল করা; মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক দেশ গড়ার লক্ষ্যে বিদ্যমান ‘স্বেচ্ছাচারী ও কর্তৃত্ববাদী’ শাসনব্যবস্থার অবসান করে সুশাসন, ন্যায়ভিত্তিক, শোষণমুক্ত এবং জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন করা; এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা অবসানের জন্য সংসদে, সরকারে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ জোরদার করা। এ ছাড়াও জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির বিপরীতে ইতিবাচক, সৃজনশীল ও কার্যকর ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করতে না দেওয়ার কথাও খসড়া প্রস্তাবনায় স্থান পেয়েছে বলে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা জানান।
খসড়া প্রস্তাবনায় আরও রয়েছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ক্ষমতা এবং মাজদার হোসেন মামলার আলোকে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ নিশ্চিত করা; ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বরের গেজেটে জারি করা নিম্ন আদালতের ওপর প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণমূলক জুডিশিয়াল সার্ভিস রুলস্ বাতিল করা; স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ এবং সুপ্রিমকোর্টের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা।
আর্থিক খাত নিয়ে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বিদ্যমান লুটপাটের অর্থনীতির অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থাপনা এবং শেয়ারবাজারসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা-দায়বদ্ধতা ফিরিয়ে এনে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং সুষম বণ্টন ও কল্যাণমুখী অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর লুটেরা, মুদ্রা পাচারকারী ও ঋণখেলাপিসহ অন্যায়কারীদের চিহ্নিত ও আইনের আওতায় আনা; জাতীয়, স্থানীয় বা কোনো পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য এ ধরনের ব্যক্তিদের অযোগ্য ঘোষণা করা।
খসড়াতে রয়েছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ ক ও ৭ খ বিলুপ্ত করা; সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিয়োগের একটি সাংবিধানিক কমিশন করা এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা নিশ্চিত করা; জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি ও দলীয়করণের বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাকে একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করে কোটা সংস্কার করা; ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সব ধর্মের স্বাধীনতা ও চর্চার অধিকার নিশ্চিত করা; পার্বত্য চট্টগ্রামসহ উপজাতি/আদিবাসী গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি সমতলের বাংলাদেশিদের মৌলিক নাগরিক ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করা।
বৈশ্বিক রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দলীয় রাজনীতিতে পরিবর্তনের কথা ভাবছে বিএনপি। বিএনপি নেতারা মনে করেন, ২০০১ সালের পর দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ‘জাতীয়তাবাদী’ চিন্তাধারার ধর্মীয় মূল্যবোধের দলটি বুঝে না বুঝে অতিমাত্রায় ‘ইসলামি’ ভাবাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এতে জনগণের একটি অংশের কাছে পছন্দের হলেও বৈশ্বিক রাজনীতিতে দলটি প্রায় বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার বছরেই বিএনপি মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করে। দেশের উত্তরাঞ্চলে জঙ্গিনেতা ‘বাংলাভাই’র উত্থান ঘটে। যে জঙ্গিবাদ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এর সঙ্গে বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর সম্পৃক্ততাও প্রকাশ পায়। কিছু বিএনপি নেতারও নাম প্রকাশিত হয়। এখান থেকেই ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিএনপি বন্ধুহীন হয়ে পড়ে।
নেতিবাচক কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক পরিম-লে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবেও জামায়াতে ইসলামীকে পরিচিতি পাইয়ে দেয়। জোটবদ্ধতার কারণে বিএনপিকেই এখন জামায়াতের কর্মকা-ের দায়ভার বহন করতে হচ্ছে। এখন বিশ্বে বিএনপির একক সত্তার চেয়ে দলটি বিএনপি-জামায়াত বা বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত হিসেবে ব্র্যান্ডিং হয়েছে। বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, এ থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই। নতুন করে যাতে ঝামেলায় পড়তে না হয়, সে জন্য সম্প্রতি দেশে ভাস্কর্যবিরোধিতায় হেফাজত সরব হলেও বিএনপি ছিল চুপ। সম্প্রতি মারা যাওয়া হেফাজতের মহাসচিব নূর হোসাইন কাশেমীর বায়তুল মোকাররমে জানাজা হলেও বিএনপির নেতাদের কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতন্ত্রকে ভিত্তি ধরেই প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে চায় দলটি। এ জন্য বছরব্যাপী কর্মসূচি নেওয়া হবে।
দলটির নেতারা বলেন, শুধু ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধতাই নয়, কিছু কর্মকা-ের কারণে দীর্ঘদিনের বন্ধুদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্কেও বৈরিতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপির খসড়ায় বিদেশনীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। খসড়ায় দেখা গেছে, সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়- এ নীতির আলোকে জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সমুন্নত রেখে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব ও সমতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ও বিনিয়োগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রস্তাব রয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাজাহান বলেন, নতুন বছর নবোদ্যমে শুরু করতে চাই। খালেদা জিয়ার পুরোপুরি মুক্তি ও নতুন একটি নির্বাচনই এখন আমাদের অন্যতম টার্গেট। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।
Leave a Reply